আগেকার কিতাব সম্পর্কে কোরআনের শীর্ষ তাফসীরবিদদের ধারণা
জাকির নায়েকের মত সমালোচকদের মূল সমস্যা হল এরা কোরআনের শীর্ষ ব্যাখ্যাকারীদের বিপরীতে কথা বলছেন, যারা ইহুদী-খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থের নির্ভরযোগ্যতা স্বীকার করতেন। প্রসিদ্ধ মুসলমান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ তার The Charge of Distortion of Jewish and Christian Scriptures (“ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থ বিকৃত করার অভিযোগ”) প্রবন্ধে এটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
“যেহেতু ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের অনুমোদিত ধর্মগ্রন্থগুলো বর্তমান পর্যন্ত অনেকটা আগের মত রয়েছে, তাই একথ বলা কঠিন যে তৌরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে কোরআনের সাক্ষ্য শুধুমাত্র মূসা ও ঈসার আমলের আগেকার “খাঁটি” তৌরাত ও ইঞ্জিলের কথা বলছেন। যদি এই কিতাবগুলোর পাঠ মোটামুটি আগেকার সপ্তম শতাব্দীর পাঠের মত থেকে থাকে, তাহলে ইঞ্জিল ও তৌরাতের প্রতি কোরআন শরীফে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা দেওয়া হয় তা এ যুগেও দেওয়া উচিত। কোরআনের অনেক তাফসীরকারীগণ, আল-তাবারী থেকে রাজি থেকে ইব্ন-তায়মিয়্য়া এমনকি কুতব্ এই মতামত পোষণ করেন। ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের কিতাবের প্রতি আধুনিক যুগে অনেক মুসলমানের যে পুরোপুরি গ্রাহ্য না করার মনোভাব আছে তা কোরআন ও তফসিরের প্রধান ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোন সমর্থন পায় না”[1]
"তাহ্রিফ (বিকৃত করা) শব্দটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে একটি জিনিস তার মূল প্রকৃতি থেকে সরিয়ে দেওয়া; এবং যেহেতু আল্লাহ্র কাছে নাজিলকৃত একটিমাত্র শব্দও বিকৃত করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, সেহেতু ইহুদী-খ্রীষ্টানরা কেবলমাত্র আল্লাহ্র বাণীর অর্থের ভুলব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিল।[2]
অন্য একটি গ্রন্থে, হযরত ইবনে আব্বাসের একই কথা পাওয়া যায়—
"এরা কালাম বিকৃত করেন" কথার মানে হচ্ছে "এরা তার অর্থ পরিবর্তন বা বিকৃত করেন"। কারণ আল্লাহ্র কোন কিতাবের একটিও শব্দ পরিবর্তন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়-- এর অর্থ হচ্ছে যে এরা কালামের ভুল ব্যাখ্যা করেন।[3]
হযরত ইবনে কাসীর 'ইবনে আব্বাসের এই একই কথা উল্লেখ করেন-
"আল্লাহ্র কিতাবের বিষয়ে, সেগুলো এখনও সংরক্ষিত এবং পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।"[4]
এই হল হযরত 'আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের তাফসীর, যিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আপন চাচাত ভাই এবং সাহাবীদের একজন। একজন সাহাবী হিসেবে তার মতামত অন্যান্য তাফসীরকারীদের চেয়ে বেশী গ্রহনযোগ্য।
বিখ্যাত তাফসীরবিদ আত-তাবারী খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছেন যে তার মতে, ইহুদী-খ্রীষ্টানদের কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত মূল কিতাবগুলো তখনও ছিল—
"সর্বপ্রথমটা ছিল তৌরাত, যেটা আহলে-কিতাবদের হাতে রয়েছে...তারপর ইঞ্জিল শরীফ, যেটা খ্রীষ্টানদের হাতেরয়েছে ।"[5]
তাবারীর মূল অভিযোগ ছিল যে এরা শুধু সেগুলোর প্রকৃত অর্থ বোঝেন নি। যদিও তিনি বাগদাদে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন, তিনি কিন্তু কখনও তাদের কিতাব পরিবর্তন করার অভিযোগ করেন নি।
বিখ্যাত তাফসীরবিদ আল-রাজীও সমর্থন করেন যে ইহুদীদের প্রতি 'তাহ্রিফ' অভিযোগ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে কীভাবে ইহুদীরা নবীজীর কথাগুলো বিকৃত করতেন।[6]
সূরা বাকারা ৭৫ আয়াতের তাফসীরে আল-রাজী ‘তাহরিফ’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন যে “শব্দের পরিবর্তন” (التَّحْرِيف اللَفْظي আল-তাহ্রিফ আল-লাফজী ) হচ্ছে—
“অসম্ভব যদি আল্লাহ্র বাণী কোরআনের মত করে বহু লোকের সামনে প্রকাশিত হয়ে থাকে”[7]
ইঞ্জিল শরীফ সম্পর্কে আমরা এই জানি যে, সেটা শুরু থেকেই বহু লোকের কাছে প্রকাশিত হল। ইমাম আল-রাজী আবার বলেন—
“এমন কোন কথা নেই যে এরা কোন শব্দ (তিল্কা-আল-লাফ্জা) কিতাব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন”[8]
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাঃ)
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাঃ) বলেন—
আবার, এই লোকদের মধ্যে (মুসলমানদের মধ্যে) এমন আছে যারা দাবী করেন যে তৌরাত ও ইঞ্জিলের মধ্যে অনেককিছু বাতিল, আল্লাহ্র কালাম নয়। কেউ কেউ বলেন বাতিল অংশই কম। আবার বলা হয় যে “কেউ লিখিত কিতাবের কোন কিছু পরিবর্তন করেন নি, বরং এরা (ইহুদী-খ্রীষ্টানগণ) এর অর্থ বিকৃত করেছেন ভুলব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই উভয় মতামতের কিছু কিছু মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে সঠিক মতামত; সেগুলো হল পৃথিবীতে সেগুলোর সহীহ্ কপি রয়েছে, এবং সেগুলো হযরত মুহাম্মদ(সা) এর আমল পর্যন্ত রয়ে গেল, এবং বিকৃত কপিও অনেক আছে। যারা দাবী করেন যে এই কপির মধ্যে কোন কিছুই বিকৃত হয়নি তারা অসম্ভব কথা দাবী করছেন। যারা বলেন যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পরে সব কপিগুলো বিকৃত করা হয়েছে, তারা প্রকাশ্য মিথ্যা বলছেন। কোরআন তো তাদেরকে বিচার করতে বলে তৌরাত ও ইঞ্জিলের মধ্যে আল্লাহ্ যা নাজিল করেছেন সেটা দিয়ে। আল্লাহ্ তাদের বলেন যে উভয় কিতাবের মধ্যে আছে হিকমত। এরা যে সকল কপি বিকৃত করেছেন তার পক্ষে কোরআনের কোন বক্তব্য নেই।”[9]
ইমাম ইবনে তায়মিয়ার মতামত নিয়ে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ মন্তব্য করেন—
এই দুই ধর্মীয় ধারার ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে নবীজী (সাঃ) এর প্রচার কাল পর্যন্ত (খ্রীষ্টাব্দ সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে) ইহুদী খ্রীষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের কিতাবের জন্য বহু পাণ্ডুলিপির প্রমাণ রয়েছে। সেই সময়ে এদের কাছে যে কিতাব ছিল, তা বর্তমানেও একই। ইঞ্জিলের ক্ষেত্রেও তাই। যেহেতু কোরআন শরীফ এই দুই কিতাবের কথা বলে, সেই কথা বর্তমান যুগেও সমানভাবে কার্যকর। তায়মিয়ার মতামত নিয়ে এটাই প্রধান সমস্যা।[10]
তা ছাড়া অন্যান্য অনেক শীর্ষ মুসলমান চিন্তাবিদ, যেমন ইমাম আল-গাজালী (রাঃ), ইমাম শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ (রাঃ) এই নিয়ে একমত ছিলেন। শুধু ইবনে কাজেম (মৃঃ ১০৬৪খ্রীঃ) এর যুগ থেকেই অনেক মুসলমানরা এই অভিযোগ শুরু করলেন যে ইহুদী-খ্রীষ্টানরা তাদের কিতাব পুরোপুরি বিকৃত করে দিয়েছেন, অর্থাৎ লিখিত পরিবর্তন। এই ছিল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনেক পরে, এবং ‘ইবনে আব্বাস (রা)-এর মত সাহাবীদের মতামতের বিপরীতে।
আগেকার কিতাব সম্পর্কে কোরআনের শীর্ষ তাফসীরবিদদের ধারণা
জাকির নায়েকের মত সমালোচকদের মূল সমস্যা হল এরা কোরআনের শীর্ষ ব্যাখ্যাকারীদের বিপরীতে কথা বলছেন, যারা ইহুদী-খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থের নির্ভরযোগ্যতা স্বীকার করতেন। প্রসিদ্ধ মুসলমান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ তার The Charge of Distortion of Jewish and Christian Scriptures (“ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থ বিকৃত করার অভিযোগ”) প্রবন্ধে এটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
হযরত 'আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)
হযরত 'আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস বলেছেন,
অন্য একটি গ্রন্থে, হযরত ইবনে আব্বাসের একই কথা পাওয়া যায়—
হযরত ইবনে কাসীর 'ইবনে আব্বাসের এই একই কথা উল্লেখ করেন-
এই হল হযরত 'আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের তাফসীর, যিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আপন চাচাত ভাই এবং সাহাবীদের একজন। একজন সাহাবী হিসেবে তার মতামত অন্যান্য তাফসীরকারীদের চেয়ে বেশী গ্রহনযোগ্য।
ইমাম আত-তাবারী (রাঃ) (৮৩৮-৯২৩ খ্রীষ্টাব্দ)
বিখ্যাত তাফসীরবিদ আত-তাবারী খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছেন যে তার মতে, ইহুদী-খ্রীষ্টানদের কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত মূল কিতাবগুলো তখনও ছিল—
তাবারীর মূল অভিযোগ ছিল যে এরা শুধু সেগুলোর প্রকৃত অর্থ বোঝেন নি। যদিও তিনি বাগদাদে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন, তিনি কিন্তু কখনও তাদের কিতাব পরিবর্তন করার অভিযোগ করেন নি।
ইমাম ফকরুদ্দিন আল-রাজী (রাঃ) (মৃঃ ১২১০ খ্রীষ্টাব্দ)
বিখ্যাত তাফসীরবিদ আল-রাজীও সমর্থন করেন যে ইহুদীদের প্রতি 'তাহ্রিফ' অভিযোগ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে কীভাবে ইহুদীরা নবীজীর কথাগুলো বিকৃত করতেন।[6]
সূরা বাকারা ৭৫ আয়াতের তাফসীরে আল-রাজী ‘তাহরিফ’ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন যে “শব্দের পরিবর্তন” (التَّحْرِيف اللَفْظي আল-তাহ্রিফ আল-লাফজী ) হচ্ছে—
ইঞ্জিল শরীফ সম্পর্কে আমরা এই জানি যে, সেটা শুরু থেকেই বহু লোকের কাছে প্রকাশিত হল। ইমাম আল-রাজী আবার বলেন—
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাঃ)
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাঃ) বলেন—
ইমাম ইবনে তায়মিয়ার মতামত নিয়ে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্ মন্তব্য করেন—
তা ছাড়া অন্যান্য অনেক শীর্ষ মুসলমান চিন্তাবিদ, যেমন ইমাম আল-গাজালী (রাঃ), ইমাম শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ (রাঃ) এই নিয়ে একমত ছিলেন। শুধু ইবনে কাজেম (মৃঃ ১০৬৪খ্রীঃ) এর যুগ থেকেই অনেক মুসলমানরা এই অভিযোগ শুরু করলেন যে ইহুদী-খ্রীষ্টানরা তাদের কিতাব পুরোপুরি বিকৃত করে দিয়েছেন, অর্থাৎ লিখিত পরিবর্তন। এই ছিল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনেক পরে, এবং ‘ইবনে আব্বাস (রা)-এর মত সাহাবীদের মতামতের বিপরীতে।
অন্যান্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ:
তৌরাত ও ইঞ্জিল কি হারিয়ে গেছে?
পূর্ববর্তী কিতাব কি বিকৃত হয়েছিল?
সূরা বাকারা ৭৯ আয়াতে বিকৃতির দাবি আছে?
"'ইঞ্জিলের মধ্যে আলো' "ছিল" নাকি "আছে"?
"কোরআনের উদ্দেশ্য কি বাণী রক্ষা করা?
ইঞ্জিল ঈসার কাছ নাজিলকৃত নাকি সাহাবীদের লেখা কিতাব?
ইঞ্জিলের মধ্যে কেন চারটি আলাদা গসপেল রয়েছে?
কোরআন কি সত্যিই 'কিতাবুল মোকাদ্দস'-এর উল্লেখ করেন?
কিতাবুল মোকাদ্দস কি অংশত আল্লাহ্র বাক্য?
হযরত ইয়াহিয়াও কি 'আল্লাহ্র কালাম'?
ইঞ্জিলের হারানো অংশ রয়েছে?
Saeed Abdullah, The Charge of Distortion of the Jewish and Christian Scriptures, The Muslim World, Vol. 92, Fall 2002, p.434. ↩︎
ইমাম বোখারী, পৃষ্ঠা ১১২৭, লাইন ৭ (A Dictionary of Islam by T.P. Hughes, (Kazi Publications, 1994) p.62. ↩︎
ইমাম বোখারী, কিতাবুল তাওহীদ, সূরাতুল বরুজ, ৮৫ ↩︎
তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরাতুল বাকারা ২৫৩-সূরাতুন-নিসা ১৪৭, পৃষ্ঠা ১৯৬ ↩︎
মুহাম্মদ বিন জরীর আত-তাবারী, তারিখ আর রুসুল ওয়াল মুলুক, পৃষ্ঠা ৫১। ↩︎
রাজী, আল-তাফসীর, ৫, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১১৮ ↩︎
রাজী, আল-তাফসীর, ১১, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৩৪ ↩︎
রাজী, আল-তাফসীর, ৫, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১১৮ ↩︎
ইবনে তায়মিয়া, আত্ তাফসীর আল কাবীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৯ ↩︎
Saeed Abdullah, The Charge of Distortion of the Jewish and Christian Scriptures, The Muslim World, Vol. 92, Fall 2002, p.434. ↩︎