An online library of rational evidence for the reliability and validity of God's Word
সূরা মায়িদা ৫:৪৬ আয়াত- পথের নির্দেশ ও আলো ‘ছিল’ নাকি ‘আছে’?
“কোরআনের সূরা মায়িদা ৫:৪৬ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘উহাতে (ইঞ্জিলে) ছিল পথের নির্দেশ ও আলো’ (অতীত কাল)।”
এই দাবীটি আরবী পাঠের ভ্রান্ত-বোধভিত্তিক। আরবী বাক্যাংশটি হচ্ছে,“الإِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ; আল ইনজিলা ফিইহি হুদায় ওয়া নূর, আক্ষরিকভাবে অনুবাদ হচ্ছে, “…এতে পথনির্দেশ ও আলো…” এখানে কোন ক্রিয়াপদ নেই, কিন্তু এতে বর্তমান কাল প্রকাশ করছে। আরবী ভাষায় বর্তমানকালের সংযোজক বাক্যে ‘হওয়া’ (‘কানা’) ক্রিয়াপদের দরকার হয় না, অনেকটা বাংলার মতন। প্রসঙ্গ অনুসারেই কাল বুঝে নিতে হয়। বিখ্যাত বাঙালি লেখক ডা.…
“ঈসা মসীহ্কে ‘প্রভু’ বলা যাবে না”
“ঈসা মসীহ্কে ‘প্রভু’ বলা যাবে না”
যেহেতু কোরআন শরীফে বলা হয় যে আল্লাহ্কে ছাড়া কোন প্রভু বা অধিপতি (রব্ব) নেই, সেহেতু অনেকে ইঞ্জিল পড়ে আপত্তি করে যে ঈসাকে ‘প্রভু’ বলা যাবে না। আসলে এর পিছনে কোরআন শরীফ নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে, কারণ কোরআন শরীফেও ফেরাউনকে “রব্ব” বা প্রভু বলা হয়:
“এবং বহু সৈন্য-শিবিরের অধিপতি ( ‘রাব্ব’) ফির’আওনের প্রতি?”
…
“প্রাচীন ঈসায়ী জামাতের মধ্যে কি অনেক বিবাদ ও দ্বন্দ্ব ছিল?”
“প্রাচীন ঈসায়ী জামাতের মধ্যে অনেক বিবাদ ও দ্বন্দ্ব ছিল, তাই কার বাণী বেরিয়ে এসেছে সেটা জানা কঠিন”
ইসলামী ইতিহাসের তুলনায়, প্রথম ঈসায়ী জামাতের মধ্যে অনেক বেশী একতা ও শান্তি ছিল। হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর থেকে বিভিন্ন মুসলমান দলের মধ্যে প্রায় অনবরত যুদ্ধ হচ্ছিল। নবীজীর ইন্তেকালের ২৫ বছর পর তাঁর বিধবা বিবি আয়েশার দল হযরত আলীর দলের বিরুদ্ধে বিখ্যাত ‘উটের যুদ্ধ’ চালালো এবং পরাজিত হল। ২৩ হিজরিতে ফিরোজ আবু লুলু নামক একজন পারস্য গোলাম খলিফা ওমর (রা)-কে ছুরিকাঘাত করেছেন। ৩৫ হিজরিতে অনেক অসন্তুষ্ট মুসলমান দল হযরত উসমান (রা)-এর ঘর অবরোধ করে তরবারি দ্বারা তাকে হত্যা করল। ৪০ হিজরিতে অন্য এক মুসলিম দল হযরত আলী (রা)-কে ছুরিকাঘাত করেছিল। ৬১ হিজরিতে উমাইয়া বংশের মুসলমানেরা এবং কুরাইশ বংশের মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং ইয়াযিদের নেতৃত্বে নবীজী (স)-র গোষ্ঠী পরাজিত হল। তারপরও অন্যান্য দলের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল যেমন মুসায়লিমা যিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়াত গ্রহণ করলেন কিন্তু নিজেকে একজন নবী বলে দাবি করলেন। ১১ হিজরিতে ইয়ামামা যুদ্ধে এই মুসায়লিমার দশ হাজার সৈন্যের বাহিনী নবীজীর দল প্রায় পরাজিত করেছিলেন।
এর তুলনায়, ঈসা মসীহ্র প্রথম অনুসারীদের সমাজের প্রথম ২৫০ বছর ধরে কোন যুদ্ধও হয় নি, কোন রাজনীতিও হয় নি, কোন মারামারিও হয় নি। সাহাবীদের যুগে তাদের মধ্যে আবার বড় ধরণের কোন বিবাদও দেখা দেয় নি। তারা একই মূল সুসংবাদের বাণী গ্রহণ করলেন, যেমন ইতিহাস প্রমাণ করে।
…
বাইবেল কি শুধু অধিকাংশই ঠিক আছে?
বাইবেলের অধিকাংশই ঠিক আছে, শুধু দু’একটি আয়াত পরিবর্তন করা হয়েছে যার ফলে পুরো বাণী বিকৃত হয়ে গেল”
যেহেতু কিতাবুল মোকাদ্দসের নির্ভরযোগ্যতার জন্য এত বেশী শক্ত প্রমাণ রয়েছে, কিছু কিছু সমালোচক বলেন যে বাইবেলের অধিকাংশই নির্ভরযোগ্য, কিন্তু দু’একটি আয়াত যোগ করা বা বাদ দেওয়াতে এর বাণী পুরোপুরি বিকৃত হয়ে গেল। যেমন, তারা স্বীকার করেন যে হযরত ঈসার মৃত্যু ও পুনরুত্থান এবং শুধু ঈমানের মাধ্যমে নাজাত পাওয়ার শিক্ষাগুলো অনেক পরে ইঞ্জিলে যোগ করা হয়েছে। তাদের কাছে যে আপত্তিকর “যোগ করানো” শিক্ষা (যার আরেক নাম ‘সুখবর’ অর্থাৎ ‘ইঞ্জিল’) এইভাবে সংক্ষিপ্ত করা যায়—
শুধু শরিয়ত পালন করার মাধ্যমে মানুষ নাজাত অর্জন করতে পারে না, কারণ তারা শরিয়ত পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পালন করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ্ তার রহমতের মাধ্যমে তিনি একটি নাজাত, কাফফারা এবং পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেন হযরত ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে, যিনি একমাত্র নিষ্পাপ ব্যক্তি, “মনোনীত নাজাতদাতা”। তিনি ক্রুশে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করলেন এবং পুনরুত্থিত হলেন। এই নাজাতের দান কোন সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায় না বরং তওবা করে ঈসা মসীহ্র উম্মত হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়।
এই সমালোচকদের কথা অনুযায়ী, উপরোক্ত শিক্ষা পরে যোগ করা হল কারণ এদের পূর্ববিশ্বাসের সঙ্গে সেটা মেলে না। এই সংশয়ীরা একথাও বলেছেন যে, ইঞ্জিলে যেখানেই ঈসাকে ‘প্রভু’ বা ‘ইবনুল্লাহ্’ বলা হয় সেটাও মূল ইঞ্জিলে ছিল না।
ইঞ্জিল শরীফ যারা পড়েছেন তাদের কাছে এই দাবী শুধু হাস্যকর, কারণ উপরোক্ত ‘সুসংবাদ’ শিক্ষাটি ইঞ্জিল শরীফের প্রত্যেকটি ২৭ খণ্ডে বার বার পাওয়া যায়। পুরো ইঞ্জিল শরীফের শিক্ষার কমপক্ষে ৫০% এর মধ্যে এই ‘সুখবর’ শিক্ষার স্বাদ পাওয়া যায়। এই শিক্ষা ছাড়া ইঞ্জিল শরীফ অর্থহীন হত।
এই একই সুসংবাদের বাণী হযরত ঈসা মসীহ্ নিজেই বার বার বলেছেন— মথি ২৬:২৮; ইউহোন্না ৩:১৫, মথি ২০:২৮; মার্ক ১০:৪৫; ইউহোন্না ১০:৯; ইউহোন্না ১৪:৬; ইউহোন্না ৬:৪৪,৪৭,৪৮,৫১; ইউহোন্না ১০:১১; ইউহোন্না ১০:২৮; ইউহোন্না ১১:২৫; ইউহোন্না ১৭:১-২; ইউহোন্না ১৭:৩; লূক ২৪:২৬-২৭; লূক ৪:৪৩; ইউহোন্না ৬:২৯; ইউহোন্না ৬:৩৩,৩৫; ইউহোন্না ৪:১৪; ইউহোন্না ৫:২১; মথি ১৮:২১-৩৫। এই একই সুসংবাদ প্রচার করেছেন হযরত ঈসার উম্মত পিতর (প্রেরিত ২:৩৮; প্রেরিত ৪:১২; ১ পিতর ১:১৮-১৯; ২ পিতর ১:১৬), উম্মত ইয়াকুব (ইয়াকুব ২:১০), এবং উম্মত ইউহোন্না (১ ইউহোন্না ২:১,২)। তা ছাড়াও, ইঞ্জিল শরীফের প্রত্যেকটি খণ্ডে ঈসা মসীহ্র সেই ‘আপত্তিকর’ উপাধি “প্রভু” এবং “ইবনুল্লাহ্” বার বার ব্যবহার হয়।
অর্থাৎ, ইঞ্জিল শরীফ থেকে এই সুসংবাদ শিক্ষাটি বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, সেটা হচ্ছে ইঞ্জিল শরীফের মর্ম।
“কোরআনে বাইবেলের কথা বলা হয় নি,
বরং শুধু তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলের কথা বলা হয়েছে”
আসলে, ইংরেজী ‘বাইবেল’ শব্দ গ্রীক βιβλία ‘বিব্লিয়া’’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “গ্রন্থগুলো” বা ল্যাটিন ভাষায় “গ্রন্থটি”। আরবী ভাষায় তা হয় الْكِتَاب (“আল-কিতাব”) অথবা الكتاب المقدس (“আল-কিতাবুল মোকাদ্দাস”), এবং হযরত মুহাম্মদের (সাঃ)-এর শত বছর আগে ও পরে বাইবেল সবসময়ই এই নামে পরিচিত। তাই যখন কোরআন শরীফে এই একই শব্দ الْكِتَاب ইহুদী-খ্রীষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধে ব্যবহার করা হয়েছে তখন কোন প্রশ্নই নাই যে সেখানে একই গ্রন্থ বোঝানো হচ্ছে—
ইয়াহূদীরা বলে, ‘খৃষ্টানদের কোন ভিত্তি নাই’ এবং খৃষ্টানরা বলে, ‘ইয়াহূদীদের কোন ভিত্তি নাই; অথচ তাহারা আল-কিতাব (الْكِتَاب) পাঠ করে। (সূরা বাকারা ২:১১৩)
“তোমরা (ইহুদীগণ) আল-কিতাব (الْكِتَاب) শিক্ষা দান কর” (সূরা আলে-‘ইমরান ৩:৭৯)
আরবী ভাষায় বাইবেলকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝানো সম্ভব না। কোরআন শরীফে যদি অন্য কোন কিছু বোঝানো হত তাহলে অবশ্য তা পরিষ্কারভাবে বলা হত।
আল্লাহ্তা’লা আমাদের কাছে অন্ধবিশ্বাস চান না, তিনি যথেষ্ট প্রমাণ সহকারে তার সত্য অবতীর্ণ করেন যেন সংশয়ীদের কাছেও সেটা অনস্বীকার্য হয়। চারজন আলাদা আলাদা সাক্ষীদের সাক্ষ্যতে হযরত ঈসার সমস্ত দাবী, অলৌকিক কাজ, মৃত্যু এবং পুনরুত্থান অস্বীকার করতে চারগুণ কঠিন হয়। দু’একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য হয়ত সন্দেহ বা প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু চারটি সাক্ষ্য সন্দেহ করা কঠিন।
তৌরাত শরীফের শরিয়ত বনি-ইসরাইলের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম রেখে গেছে—
“মাত্র একজন সাক্ষী দাঁড়ালে চলবে না; দুই বা তিনজন সাক্ষীর কথা ছাড়া কোন বিষয় সত্যি বলে প্রমাণিত হতে পারবে না।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১৯:১৫)
তৌরাতের এই নিয়ম অনুযায়ী বনি-ইসরাইলের কাছে হযরত ঈসার বাণী প্রমাণ করার জন্য একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যর প্রয়োজন ছিল।
তারপরেও, ইঞ্জিল এবং কোরআন থেকে আমরা জানি যে হযরত ঈসা ছিলেন নিজেই আল্লাহ্র জীবন্ত কালাম, এবং তাই ইঞ্জিলের মূল ভূমিকা হচ্ছে সেই জীবন্ত কালামের জীবন এবং শিক্ষা সম্বন্ধে সাক্ষ্য হওয়া। অর্থাৎ হযরত ঈসার ক্ষেত্রে নবীই প্রধান, কিতাব অপ্রধান।
চারটি সুখবর থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, আলাদা আলাদা সাক্ষীর দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হযরত ঈসার জীবন ও শিক্ষা সম্বন্ধে আরও বেশী শিক্ষালাভ করতে পারি, যেহেতু প্রত্যেক দলিলে ঈসার কাজের বিশেষ একটি দিকের উপর জোর দেওয়া হয়।
১৮০ খ্রীষ্টাব্দে, ঈসায়ী নেতা এরেনেউস এই চারটি সুখবর (মথি,মার্ক,লূক,ইউহোন্না) সম্বন্ধে বলেছেন—
সুখবরগুলোর সংখ্যা যে চারের বেশী অথবা চারের কম হবে তা সম্ভব নয়, কারণ যেহেতু আমাদের এই দুনিয়ার চার দিক আছে, এবং চারটি প্রধান বায়ু, যখন ঈসায়ী জামাত দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে, এবং জামাতের ভিত্তি এবং স্তম্ভ হল সেই ইঞ্জিল এবং জীবন্ত রূহ্; সেহেতু তা যুক্তিসঙ্গত হয় যে এর স্তম্ভও চারটি থাকবে, চারদিকে নিঃশ্বসিত হচ্ছে অনন্ত জীবন…কারণ জীবন্ত প্রাণী হল চতুর্পদ, এবং সুখবরও তেমনই চতুর্গুণ।১
এই ইরিনেওস ছিলেন সাহাবী ইউহোন্নার “রূহানি নাতি”, কারণ তিনি ঈসার প্রিয় উম্মত এবং ইউহোন্না-সমাচারের লেখক হযরত ইউহোন্নার শিষ্য পলিকার্পের শিষ্য ছিলেন।
ঈসার কাছে একটি ইঞ্জিল, নাকি তার অনুসারীদের কাছে চারটি ইঞ্জিল?
“কোরআন শরীফে হযরত ঈসার কাছে নাজিলকৃত একটি ইঞ্জিলের কথা বলা হয়, কিন্তু বর্তমান ইঞ্জিল লিখেছেন তার সাহাবীরা”
এই অভিযোগের মধ্যে চারটি প্রশ্ন আছে:
কোরআন শরীফে যেমন বলা হয়, ঈসা মসীহ্ সত্যই “ইঞ্জিল” (অর্থাৎ সুসংবাদের বাণী) পেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ঈসার জীবনকালে একটি বই ছিল না বরং একটি বাণী বা শিক্ষা। সেই শিক্ষা “ইঞ্জিল” কিতাবের মধ্যে পাওয়া যায়।
হযরত ঈসা এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উভয়ই নিজে কোন কিতাব লিখে রাখেননি, যদিও বর্তমান কাল অনেকে এমনভাবে কথা বলে থাকেন। তাদের মৃত্যুর পরে সাহাবীগণ তাদের কিতাব লিখে রেখেছেন।
হযরত ঈসার ইঞ্জিল শরীফ একটু ভিন্নভাবে নাজিল হয়েছে। অধিকাংশ নবীদের ক্ষেত্রে, যেমন হযরত ইশাইয়া (আঃ) এবং হযরত ইয়ারমিয়া (আঃ), আল্লাহ্ তাদের কাছে একটি বিশেষ বাণী নাজিল করেছেন “আল্লাহ্র কালাম” হিসাবে, এবং তাই সেই নবীর কিতাব হল সেই লিখিত আল্লাহ্র বিশেষ বাণী।
কিন্তু ইঞ্জিল কোরআন উভয় গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে, হযরত ঈসা হচ্ছেন নিজেই একক “আল্লাহ্র বাণী,” অর্থাৎ তিনি নিজেই ছিলেন প্রধান বাণী।
অন্যান্য নবীরা লিখিত বাণী (“আল্লাহ্র কালাম”) নিয়ে আসলেন, কিন্তু হযরত ঈসার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তিনি নিজেই আল্লাহ্র জীবন্ত বাণী ছিলেন, এবং এইজন্য তার কিতাব (ইঞ্জিল) অপ্রধান, বরং হযরত ঈসাই প্রধান বাণী। ইঞ্জিল কিতাব হচ্ছে সেই জীবন্ত আল্লাহ্র বাণীর জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে পাক-রূহের পরিচালনায় লিখিত সাক্ষীদের পবিত্র লিখিত বর্ণনা। হযরত ঈসা নিজেই তার সাহাবীদের এমন দায়িত্ব দিয়ে গেলেন, যেন তারা দুনিয়ার কাছে তার জীবন ও সমস্ত শিক্ষা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয় (ইঞ্জিল, মথি ২৮:১৮-২০)। তিনি আবার প্রতিজ্ঞা করলেন যে পাক রূহ্ নিজেই তার শিক্ষা সম্বন্ধে সাহাবীদের মনে করিয়ে দেবেন (ইউহোন্না ১৪:২৬)। আল্লাহ্র জীবন্ত কালাম সম্পর্কে এই পবিত্র বাণী সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে, মসীহ্র বারজন উম্মত এবং তাদের সঙ্গীরা পাক-রূহের পরিচালনায় মসীহ্র জীবন-চরিত এবং শিক্ষা লিখে রাখলেন ইঞ্জিল কিতাব হিসাবে।
ইঞ্জিলের শব্দার্থ
তাহলে “ইঞ্জিল” সম্পর্কে আমরা কোরআনে কী ধারণা পাই?…
“ঈসা মসীহ্কে কেন ‘আল্লাহ্র পুত্র’ বলা হয়?”
“ঈসা মসীহ্কে কেন ‘আল্লাহ্র পুত্র’ বলা হয়?”
উদাহরণস্বরূপ কোন এক সময়ে ইসলামের অনুসারীদের এক অংশের মধ্যে বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল যে, আল্লাহ্তা’আলার দেহ বা হাত পা ছিল। তারা বিশ্বাস করত, আল্লাহ্ ছিল হাত, মুখ ইত্যাদি দৈহিক অঙ্গপ্রতঙ্গ ধারণকারী। কোরআন ও হাদিসের অংশ বিশেষের আক্ষরিক বর্ণনার ফলে, এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করে তুলেছেন। যেমন ইসলামী দর্শনে লেখা আছে
“এদের (যাহারিয়া ও মুশাব্বিহা) মতে, আল্লাহ্ শরীরী, আপন আসনে আসীন। তাঁর হাত মুখ আছে। তিনি রসুল করীমের পবিত্র স্কন্ধে হাত রাখেন এবং রসুল করীমও তার হাতের স্নিগ্ধতা অনুভব করেন।”
পরবর্তীতে অবশ্যই ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, আক্ষরিক দৃষ্টিকোণে ঐ সব অংশের ব্যাখ্যা দেয়া বা গ্রহণ করা যাবে না। ঐ সব অংশকে সব সময় অলংকারিক রূপক অর্থে গণ্য করতে হবে।
রূপক ব্যাখ্যা
এক সময়ে এটা বুঝতে পারা গেল যে, ধর্মগ্রন্থের কোন কোন অংশকে রূপকভাব অবশ্যই গণ্য করতে হবে। এর পরে কীভাবে অন্যান্য কঠিন অংশগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যেমন নিম্নলিখিত হাদিসগুলো আক্ষরিক অর্থে বুঝতে খুবই কষ্টকর ছিল। রসুল করিম বলেছিলেন:
“কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) হলো আল্লাহ্র হাত।”
“মুসলমানের অন্তর আল্লাহ্র আঙ্গুলসমূহের মধ্যে অবস্থিত।”
“আমি ইয়ামেন থেকে আল্লাহ্র খোশবু পাচ্ছি”
এখানে অপ্রত্যক্ষ এবং রূপক ব্যাখ্যা গ্রহণ করায় সমস্ত অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়েছে এবং প্রকৃত অর্থ স্পষ্টরূপে ভেসে উঠেছে।
আগেকার ভুল বুঝাবুঝি
উক্ত প্রকৃতির ধর্মীয় ভুল বুঝাবুঝি শুধুমাত্র কোরআন এবং হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলের মধ্যেও এমন বহু ব্যাখ্যার জটিলতা আছে। যেমন, নবিদের উপাধিগুলো নিয়ে সহজেই ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা সম্ভব।
ইবরাহিম খলিলুল্লাহ্
উদাহরণস্বরূপ আমরা হযরত ইবরাহিম (আঃ) সম্বন্ধে একটু চিন্তা করতে পারি। তাঁকে উপাধিটা দেয়া হয়েছিল ‘খলিলুল্লাহ্’ বা ‘আল্লাহ্র দোস্ত’। এখানে যারা আক্ষরিক অর্থ উপাধিটা বুঝতে চায়, তাদের অনেক জটিলতা ও সমস্যা রয়েছে। কারণ মানুষের দোস্ত থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্র দোস্ত থাকা কেমন করে সম্ভব?…
“আল্লাহ্র কালামের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ভাষা আরবী”
“আল্লাহ্র কালামের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ভাষা আরবী”
অনেকে মনে করেন যে আল্লাহ্র কালাম হল অনন্ত দিন আগে থেকে বেহেশতে সংরক্ষিত আল্লাহ্র মুখে উচ্চারিত কথা। এই ভিত্তিতে অনেকে তাবিজ-কবচ, মন্ত্রপাঠ এবং পানি-পড়ার মাধ্যমে কোরআন শরীফের আয়াত ব্যবহার করে। কিন্তু এই ধারণা আসলে ভুল – অন্যান্য ভাষার মত আরবী ভাষাও একটি আঞ্চলিক অস্থায়ী এবং বিবর্তিত ভাষা, কিন্তু আল্লাহ্ অসীম, সর্বজনীন এবং চিরন্তন। আরবী ভাষার বিভিন্ন হরফ সঠিকভাবে উচ্চারণ করার জন্য দাঁত লাগে, কণ্ঠ লাগে, জিভ লাগে। আল্লাহ্র কি দাঁত, কণ্ঠ, জিভ আছে?…
কিতাবুল মোকাদ্দস কি মানুষের গল্পের মত?
কিতাবুল মোকাদ্দস সহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পড়তে মানুষের গল্পের মত হয়,
কিন্তু কোরআন শরীফ সেরকম না”
আসলে অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ পড়তে কাহিনীর মত নয় বরং এলোমেলো মন্ত্রের মত।
আল্লাহ্র কালামের মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্র ইচ্ছা মানব জাতির কাছে সুন্দরভাবে, স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। এইজন্য তিনি যেহেতু সবকিছুতে শ্রেষ্ঠ, তার কালাম এলোমেলো উক্তি বা অসংলগ্ন মন্ত্রতন্ত্রের মত হবে না, বরং ভূমিকা ও উপসংহার সহ সুন্দর ও ধারাবাহিক একটি পরিপূর্ণ লেখা – যেভাবে সকল যুক্তিসঙ্গত যোগাযোগ হয়। কিতাবুল মোকাদ্দসে আমরা এমন লেখা পাই। চিন্তা করেন – কোন স্কুল টেক্সটবুক বা প্রবন্ধ যদি প্রতিটি তিন লাইন পরপর হঠাৎ করে আলোচনার বিষয় পরিবর্তন হত, তাহলে সেটা কোন সুশিক্ষিত লোক ব্যবহার করত না।
আল্লাহ্ অবশ্য মানুষের ভাষার চেয়ে মহান, কিন্তু যখন মানবজাতির কাছে তিনি তার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন মানুষদের ভাষায়, তখন তিনি স্পষ্ট যোগাযোগে শ্রেষ্ঠ। তার কালাম যদি অস্পষ্ট এবং অসংলগ্ন হত, তাহলে তার অস্পষ্ট দূর্বল কালাম সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষ আরো স্পষ্ট বিকল্প ধর্মীয় বই লিখতে হত (নাউজুবিল্লাহ)। না, তার অসীম জ্ঞানে মাবুদ আল্লাহ্ তার কালাম নিখঁত এবং পরিপূর্ণ করেছেন। তার মধ্যে আছে ইতিহাসে আল্লাহ্র বিভিন্ন কাজের স্পষ্ট বিবরণ, এবং ধর্মসংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ের যথেষ্ট বিস্তারিত আলোচনা আল্লাহ্র কালামে পাওয়া যায়। হেদায়েতের জন্য অন্য কোথাও যাওয়া দরকার নেই।
আসলে কিতাবুল মোকাদ্দসের একটি আশ্চর্য বিষয় হল যে ২০০০ বছর জুড়ে প্রায় ৪০ আলাদা ব্যক্তির কাছে প্রদত্ত বাণী হলেও, তার মধ্যেকার লেখার এত স্পষ্ট মিল আছে। তার শুরুতে আছে ভূমিকা (পয়দায়েশ ১-১১), মাঝখানে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয় আল্লাহ্র মহাপরিকল্পনা, এবং শেষ কিতাবে আছে ভবিষ্যতের সমাপ্ত। তার মধ্যে আল্লাহ্র ইচ্ছা ভালভাবে জানার জন্য যথেষ্ট বিবরণ আছে—কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাদ দেওয়া হয় নি বা অন্য কোন ব্যাখ্যা বা টেক্সটবুক বা মানুষের লেখার কাছে যেতে হয় না। শুধুমাত্র নিজ মাতৃভাষায় আল্লাহ্র কালাম থাকলে, বিশ্বের যেকোন লোকের কাছে থাকত আল্লাহ্র পূর্ণাঙ্গ ইচ্ছা জানার জন্য যথেষ্ট হেদায়েত।
মরিস বুকাইলি দাবি করেছেন যে ইঞ্জিল শরীফের গসপেলগুলো রূপকাহিনী Song of Roland এর মত, “যেটা একটা বাস্তব ঘটনা মিথ্যা ভাবে সাজায়”।১ বুকাইলির দাবি হল যে ইঞ্জিলের গল্পগুলো ঐতিহাসিক বর্ণনা হিসেবে লেখা হয়নি বরং সৃজনশীল উপন্যাস হিসেবে লেখা হয়েছে। ডাঃ মৌরিস বুকাইলি কোন সাহ্যিতের বিশেষজ্ঞ নয়, কিন্তু বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিশেষজ্ঞ C.S.…