সকল নবী কি নিষ্পাপ?
সকল নবী কি নিষ্পাপ?
এখন পাপ সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করা দরকার। আল্লাহ্ যে নবী পয়গম্বরদের পাঠিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে একটি ভূল ধারণা প্রায় সব মানুষই পোষন করে আর তা হল যে সমস্ত নবীরাই নিষ্পাপ। এই ধারণা আল্লাহ্র কালাম ও সাধারণ যুক্তির বিপরীত। এটি সাধারণ যুক্তির বিপরীত কারণ নবীরাও আমাদের মতো আদমের বংশভূত এবং তাঁদেরও ওই একই গুনাহ্-স্বভাব ও আত্মকেন্দ্রিক জীবন ছিল। এটা আল্লাহ্র কালামের বিপরীত কারণ আল্লাহ্র কিতাবে নবীদের গুনাহ্ সম্পর্কে পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আল্লাহ্র কালাম নবীদের ভুল-ত্রু টি ও আল্লাহ্কে অমান্য করার ঘটনার সাথে তাঁদের গভীর ঈমান ও বাধ্যতার কথাও সুস্পষ্টভাবে বলে। নবীদের জীবন সম্পর্কে সুন্দর ব্যাপারটা হল, যদিও তাঁরা পাপ করেছিল তবুও তাঁরা তওবা করে আল্লাহ্র ক্ষমা পেয়েছিলেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, কোরআনে নবীরা যে সব পাপ করেছিলেন সে সব বিষয়ে পরিষ্কার বিশ্লেষণ না থাকলেও নবীরা আল্লাহ্র কাছে যে অনুশোচনা করেছেন তার উল্লেখ আছে। নবীদের অবাধ্যতার একটা পরিষ্কার চিত্র পেতে হলে এবং তাদেরকে কেন তওবা করতে বলা হয়েছে তা জানতে হলে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে খোঁজ করতে হবে। এই বিষয়ে কোরআনের কিছু অংশ নিচে দেওয়া হল। এই আয়াতগুলি পরিষ্কারভাবে বুঝায় যে নবীরাও পাপী ছিলেন আর আল্লাহ্র ক্ষমা তাঁদের দরকার ছিল।
হযরত মূসা (আঃ)
“এবং আশা করি, তিনি [আল্লাহ্] কিয়ামত দিবসে আমার আপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা শু’আরা’ ২৬:৮২)
হযরত ইবরাহীম (আঃ)
“সে [মূসা নবী] নগরীতে প্রবেশ করিল, যখন ইহার অধিবাসীরা ছিলো অসতর্ক। সেথায় সে দুইটি লোককে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখিল, একজন তাহার নিজ দলের এবং আপর জন তাহার শত্রুদলের। মূসার দলের লোকটি উহার শত্রুর বিরুদ্ধে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করিল, তখন মূসা উহাকে ঘুসি মারিল; এইভাবে সে তাহাকে হত্যা করিয়া বসিল। মূসা বলিল, ইহা শয়তানের কাণ্ড। সে তো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান-কারী।” (কোরআন শরীফ, সূরা কাসাস ২৮:১৫-১৬)
হযরত ইউনুস (আঃ)
“ইউনুসও ছিলো রাসূলদের একজন। স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করিয়া বোঝাই নৌযানে পৌঁছিল, অতঃপর সে লটারীতে যোগদান করিল এবং পরাভুত হইল। পরে এক বৃহদাকার মৎস্য তাহাকে গিলিয়া ফেলিল, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগিল। সে যদি আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করিত, তা হইলে তাহাকে উত্থান দিবস পর্যন- থাকিতে হইত উহার উদরে। অতঃপর ইউনুসকে আমি নিক্ষেপ করিলাম এক তৃণহীন প্রান-রে এবং সে ছিলো রুগ্ন। পরে আমি তাহার উপর এক লাউ গাছ উদ্গত করিলাম, তাহাকে আমি এক লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করিয়াছিলাম। এবং তাহারা ঈমান আনিয়াছিল; ফলে আমি তাহাদিগকে কিছু কালের জীবনোপভোগ করিতে দিলাম।” (কোরআন শরীফ, সূরা সাফ্ফাত ৩৭:১৩৯-১৪৮)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
“এতএব তুমি [হে মুহাম্মাদ] ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি সত্য, তুমি তোমার ক্রটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর সকাল ও সন্ধ্যায়।” (কোরআন শরীফ, সূরা মুমিন ৪০:৫৫
“সুতরাং জানিয়া রাখ [হে মুহাম্মাদ], আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই, ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার এবং মু’মিন নর-নারীদের ক্রটির জন্য আল্লাহ্ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস’ান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৯)
“নিশ্চয়ই [হে মুহাম্মাদ] আমি তোমাদিগকে দিয়াছি সুস্পষ্ট বিজয়, যেন আল্লাহ্ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত ক্রটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁহার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন, এবং আল্লাহ্ তোমাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা ফাত্হ ৪৮:১-৩)
গুনাহ্ ও তার খারাপ ফালাফল কী, তা ভালভাবে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ মনে করে যে বর্তমান সময়ে প্রচলিত কোন জনপ্রিয় প্রণালী বা তন্ত্র যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ ব্যবহারের দ্বারাই দারিদ্র, অসাম্য, দুর্দশার মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবসত, আল্লাহ্র কালাম আমাদের এই রকম এতো সহজ সমাধানের কথা বলে না। সব থেকে ভাল আবিস্কৃত তন্ত্রও মানুষের দ্বারাই চালিত যে নিজেই স্বার্থপর ও কুলষিত এবং তার পরিচালনায় তার তন্ত্র সমাজকে অবিচার ও কষ্টের মধ্যেই নিয়ে যায়।
মানব সমাজের সমস্যাটা বাহিরের এই পন্থাগুলো নিয়ে নয় বরং তা মানুষের হৃদয়ের ভিতরের পন্থাকে নিয়েই। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ প্রতিদিন গোসল করে ও নিত্য নতুন কাপড় পরিবর্তন করে পরিষ্কার থাকতে পারে ঠিকই কিন্তু সেভাবে যে রোগ তাকে ভিতর থেকে নিঃশেষ করে ফেলছে তাকে কিছুতেই সে দূর করতে পারবে না । মানব সমাজের এই বিশ্বজনীন যে নিপীড়ন তা কোন ভুল প্রথার জন্য নয়, তা বরং মানুষের পাপের জন্যই যা এই প্রথাগুলোকে পরিচালনা করে। অন্য দিকে, যদি একটা খারাপ প্রথা ভাল মানুষদের দ্বারা চালিত হয় তাহলে কিছু সময়ের মধ্যে তারা সেই প্রথাকে নির্ভুল করে তা ব্যবহার করে পৃথিবিকে কয়েক বছরের মধ্যেই বেহেশতে রূপান্তর করা সম্ভব হত।
প্রধান যে জিনিসটি যা আমাদের দরকার তা হল আমাদের হৃদয়ের পরিষ্কারকরণ । মন পরিবর্তন না হলে শুধু বাহিরকে পরিবর্তন করলেই হবে না। আদম-হাওয়ার পাপের মাধ্যমে যা বেঠিক হল তাকে আবার সঠিক করতে হবে। আমাদের স্বার্থপর কামনা বাসনা ও ইচ্ছা থেকে ফিরে আল্লাহ্র দিকে ফিরতে হবে যাতে আমরা তাঁর রাজ্যের ভাগি হতে পারি।
এই ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকেই দুইটি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি। প্রথমত, আমরা কি নিজেরা স্বীকার করতে রাজি আছি যে, আমি পাপি আর আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমা না পেলে কেয়ামতের দিনে শুধু ভর্তসনা ও শাস্তি আশা করতে পারি?…
ইউহোন্না ১০:৮ – নবীরা কি চোর ও ডাকাত?”
ইউহোন্না ১০:৮—“ঈসা কীভাবে বলতে পারেন যে আগেকার সমস্ত নবী-পয়গম্বর ছিলেন চোর ও ডাকাত?”
ইঞ্জিলের উপর এই আক্রমন খুব দুর্বল। ইঞ্জিলের একটুমাত্র পড়লে বোঝা যায় যে ঈসা মসীহ্ আগেকার নবীদের খুব সম্মান করতেন (যেমন মথি ৫:১৭; মথি ১২:৩; লূক ১৩:২৮; ইউহোন্না জ৮:৩৯,৪০)। এইজন্য বোঝা যায় যে ঈসা মসীহ্ এখানে প্রকৃত নবীদের “চোর ও ডাকাত” বলেননি, বরং ভণ্ড নবী ও ভণ্ড ‘মসীহ’দের “চোর ও ডাকাত” বলেছিলেন (যারা নবীদের যুগের পরে এসে নিজেকে নবী বা মসীহ্ বলে মানুষকে ঠকিয়েছে)। তেমনভাবেও নবী ইহিষ্কেল তাদের সমালোচনা করেছিলেন, যারা নিজেকে ইহুদীদের নেতা বা নবী বলে কিন্তু শুধু নিজেকে সেবা করে। ঈসা মসীহ্ তাদের ‘চোর’ বলেছিলেন কারণ তারা অনেকসময় কৌশলে মানুষকে আকৃষ্ট করতেন এবং ‘ডাকাত’ বলতেন কারণ ভণ্ড নেতারা হিংস্রতা ব্যবহার করতেন।
…
মথি ১৫:২৬ – বিদেশিনীকে ‘কুকুর’ বলা?
<h2 class=”objection”>মথি ১৫:২৬—“ঈসা মসীহ্ কেমন করে একজন বিদেশী মহিলাকে ‘কুকুর’ বলতে পারে?”</h2>
তখনকার সমাজে দুই ধরনের কুকুর ছিল—একটা খারাপ (বন্য ও নোংরা), আরেকটি ভাল যারা মেষ দেখাশোনা করতে খুব গুণী ছিল। ইহুদীরা প্রায়ই অ-ইহুদীদের গালি হিসেবে “κύων” (কুওন) বলতেন, যাকে দিয়ে বোঝানো হত রাস্তার নোংরা কুকুর। কিন্তু এখানে মসীহ্ সেই সব্দ ব্যবহার করেননি, তিনি বলেছিলেন “κυνάριον” (কুনারিওন) অর্থাৎ গৃহপালিত বাচ্চা-কুকুর যারা ঘরের মধ্যে থাকত, সম্ভবত মেষ-পালকদের বাসায়। বাংলায় যেমন “অমুক প্রাণীর-বাচ্চা” একটি গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, গ্রীক ভাষায় কিন্তু সেরকম অর্থ নেই, “বাচ্চা-প্রাণী” একটি আদরের ডাক হিসেবে ব্যবহার করা হত। যদি এটা একটি গালি হত, তাহলে মহিলাটি অবশ্য রেগে যেত বা চলে যেত; কিন্তু এই কথা শুনবার পরেও তিনি ঈসার সাহায্য চেয়েছিলেন, এবং শেষ ঈসা মসীহ্ মহিলাটির ঈমান প্রশংসা করেছিলেন।<p>
এখানে ঈসার পুরো গল্প দেখতে হবে—তিনি বাড়ীর বিভিন্ন ভাগ (মালিক, সন্তান, গৃহপালিত পশু, ইত্যাদি) দিয়ে বোঝাচ্ছে যে তার তবলিগ কাজের ক্ষেত্রেও প্রথমত ইহুদীদের কাছে তার প্রচার করার দায়িত্ব ছিল। <p>
কোরআন শরীফও বিভিন্ন খারাপ জাতি বা মানুষকে পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়—“কুকুর” (৭:১৭৫-১৭৭), “পশু” (৮:২২,২৫), এবং “গাধা” (৬২:৫)।
…
ঈসা মসীহ্ কি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন?
দুটি আয়াত দিয়ে ঈসা-বিরোধী সমালোচকেরা বলেন যে হযরত ঈসা শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য। অবশ্য, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ক্ষেত্রে এই কথা হয়ত বলা যায়, কারন কোরআন শরীফে লেখা আছে:
“এমনি ভাবে আমি আপনার প্রতি [মুহাম্মদ] আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ-পাশের লোকদের সতর্ক করেন” (সুরা আশ-শুরা ৪২:৭)
কিন্তু ইঞ্জিল শরীফের পুরো সাক্ষ্য দেখলে বোঝা যায় যে ঈসা মসীহ্ প্রথমত ইহুদীদের কাছে গেলেন কিন্তু তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য। কিন্তু প্রথমে আমরা সেই দুই ভুলব্যাখ্যাকৃত আয়াত দেখব:
মথি ১০:৫—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন”
মথি ১০ অধ্যায়ে ঈসা মসীহ্ তার সাহাবীদের পাঠিয়েছিলেন একটি বিশেষ সময়ের জন্য, এবার শুধু ইহুদীদের কাছে। এই যাত্রার নিয়ম নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য দেওয়া হল, কারণ ইঞ্জিলে এই যাত্রার সমাপ্তির বর্ণনা আছে (লূক ৯), এবং পরে ঈসা মসীহ্ এই যাত্রার কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেছিলেন (লূক ২২:৩৫-৩৬)।
মথি ১৫:২১-২৮—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন
মথি ১৫:২১-২৮ (এবং মার্ক ৭:২৩-৩০) অনুচ্ছেদে ঈসা মসীহ্ একজন কেনানীয় মহিলাকে বোঝাছিলেন যে তার তবলিগ কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের কাছে।
এই দুই আয়াতের দশগুণ বেশী আয়াত ইঞ্জিলে পাওয়া যায় যেখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে মসীহ্র বাণী সমস্ত জাতির জন্য, এমনকি তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাবেও এমন কথা আছে। অবশ্য তার দুনিয়াবি প্রচার-কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ছিল, কারণ হযরত ইবরাহিমের সময় থেকেই এই ইসরাইল জাতি ছিল আল্লাহ্র বাণীর হাতিয়ার। এইজন্য ঈসা মসীহ্ বনি-ইসরাইলীয়দের মধ্যে প্রচার করেছিলেন।
কিন্তু ঈসা মসীহ্র ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থিত হওয়ার পরপরেই নতুন একটি যুগ শুরু হল, আল্লাহ্ ও মানবজাতির মধ্যে নতুন একটি চুক্তি বা ব্যবস্থা ঈসা বহাল করেছিলেন। আগে জাতিরা ইসরাইলের মাধ্যমে আল্লাহ্র সম্বন্ধে জানতে পারত, কিন্তু তখন থেকে সরাসরি ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে সমস্ত জাতি আল্লাহ্র কাছে আসতে পারে। ঈসার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেও ঈসা বলেছিলেন:
“আমিই দুনিয়ার নূর।” (ইউহোন্না ৮:১২)
“আমিই পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না।” (ইউহোন্না ১৪:৬)
ঈসা বলেছিলেন যে তার আত্ম-উৎসর্গ হবে:
“মানুষ যেন জীবন পায় সেইজন্য আমি আমার এই শরীর দেব।” (ইউহোন্না ৬:৫১)
এবং মসীহ্র বিষয় একটি ভবিষ্যদ্বানী মথি উল্লেখ করেছিলেন যে:
“তাঁরই উপর অ-ইহুদীরা আশা রাখবে।” (মথি ১২:২১)
যখন ইমাম শামাউন ঈসাকে বাইতুল মোকাদ্দসে ঈসাকে দেখতে পেলেন তিনি বললেন:
“আমার চোখ তোমার নাজাতের ব্যবস্থা দেখেছে…অন্য জাতির কাছে এটা পথ দেখাবার নূর” (লূক ২:৩১-৩২)
তার ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থানের পরে, ঈসা মসীহ্ সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য:
এইজন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক-রূহের নামে তাদের তরিকাবন্দী দাও। আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি তা পালন করতে তাদের শিক্ষা দাও। দেখ, যুগের শেষ পর্যন্ত সব সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি।” (মথি ১৮:১৯-২০)
লূকে সাহাবীদের কাছে ঈসা একই রকম হুকুম দিয়েছিলেন:
“জেরুজালেম থেকে শুরু করে সমস্ত জাতির কাছে মসীহের নামে এই খবর তবলিগ করা হবে যে, তওবা করলে গুনাহের মাফ পাওয়া যায়। তোমরাই এই সমস্ত বিষয়ের সাক্ষী।” (লূক ২৪:৪৬-৪৮)
এবং প্রেরিত কিতাবে তিনি সাহাবীদের হুকুম দিলেন:
তিনি তাদের বললেন, “জেরুজালেম, সারা এহুদিয়া ও সামেরিয়া প্রদেশে এবং দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত তোমরা আমার সাক্ষী হবে।” (প্রেরিত ১:৮)
একজন ব্যক্তির শেষ বাণীর উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়—এটাই ছিল ঈসা মসীহ্র শেষ হুকুম।
এর পরেও আগেকার কিতাবের বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বানীতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে মসীহ্ সমস্ত জাতির জন্য ছিল। নবী ইশাইয়া লিখেছিলেন যে:
“সেই দিন ইয়াসিরের মূল সব জাতির জন্য নিশানের মত হয়ে দাঁড়াবেন; সব জাতি তাঁর কাছে জমায়েত হবে” (ইশাইয়া ১১:১০)
এবং
“দূরের লোকেরা তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে।” (ইশাইয়া ৪২:৪)
তেমনই ভাবে দানিয়েল নবী তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে:
সেই ইবনে আদমকে কর্তৃত্ব, সম্মান ও রাজত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল যেন সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে। তাঁর রাজত্ব চিরস্থায়ী; তা শেষ হবে না আর তাঁর রাজ্য কখনও ধ্বংস হবে না। (দানিয়েল ৭:১৪)
ঈসা মসীহ্র বারজন সাহাবী মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জাতির কাছে মসীহ্র বাণী প্রচার করতে লাগলেন। তারা তো ঈসার শিক্ষা খুব ভালভাবে জানতেন। যদি ঈসা ‘কেবল ইহুদীদের জন্য’ হতেন, তাহলে তারা কেন জাতির কাছে তার বাণী প্রচার করতে করতে তাদের সারা জীবন নষ্ট করতেন কেন?…
ঈসার শিক্ষা অনুযায়ী কি শরিয়ত দ্বারা নাজাত পাওয়া যায়?
ঈসা মসীহের অন্যান্য ভূমিকা এড়ানোর জন্য দুএকটি আয়াতের ভিত্তিতে (মথি ৫:১৭, মথি ১৯:১৬-৩০) বলা হয় যে তিনি শুধু শরিয়ত সমর্থন করতে আসলেন। এটাই তাদের অভ্যাস— দুএকটি আয়াত ভুল-ব্যাখ্যা করা এবং বাকি ৯৯ আয়াত অবহেলা করা। তাই আসুন, আমরা তৌরাত থেকে শুরু করে ভালভাবে দেখব কিতাবুল মোকাদ্দসে নাজাত এবং শরিয়তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করি:
তৌরাত শরীফে নাজাত
হযরত ঈসা যখন বার বার বললেন যে নাজাত শরিয়তের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না বরং রহমতের মাধ্যমে আসে, এটা কোন নতুন শিক্ষা ছিল না বরং তৌরাত এবং নবীদের কিতাবের শিক্ষার সঙ্গে মিলে যায়। তৌরাত শরীফ থেকে বলা হয়েছে যে নাজাত আসবে একজন ‘মসীহ্’ এর মাধ্যমে। পয়দায়েশে বলা হয়েছে যে ইবরাহিম “মাবুদের কথার উপর ঈমান আনলেন আর মাবুদ সেইজন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” (পয়দায়েশ ১৫:৬)—তার ঈমানের জন্য, প্রচেষ্টার জন্য নয়।
হযরত মূসার শরিয়তে, এমন কথা কোথাও বলা হয় নি যে ‘এই শরিয়ত পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে’:
“বনি-ইসরাইলরা, তোমরা আমার কথা শোন এবং সতর্ক হয়ে এই সব মেনে চল, যাতে দুধ আর মধুতে ভরা সেই দেশে যাবার পরে তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্র ওয়াদা অনুসারে তোমাদের উন্নতি হয় আর তোমরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠতে পার।”(দ্বিতীয়বিবরণ ৬:৩)
বনি-ইসরাইলীয়দের জন্য মূসার শরয়িত পালনের পুরস্কার বেহেশত নয়, বরং প্যালেষ্টাইনে শান্তি ও সফলতা। আবার এই শরিয়তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাপ সম্বন্ধে চেতনা, যেন আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ্র ইচ্ছা কী কী এবং যে আমরা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পালন করচ্ছি না।
জবুর শরীফে নাজাত
প্রথমত, দাউদ নবীর জবুর শরীফে বলা হয় যে আল্লাহ্র সামনে সকল মানুষ গুনাহ্গার এবং নাজাত পাওয়ার অযোগ্য:
“আমার অন্যায়ের মধ্যে আমি ডুবে গেছি;
তা এমন বোঝার মত হয়েছে যা আমি বইতে পারি না।” (জবুর ৩৮:৪)
“তোমার এই সেবাকারীর বিচার কোরো না,
কারণ তোমার চোখে কোন প্রাণীই নির্দোষ নয়।” (জবুর ১৪৩:২)
“তুমি আমার গুনাহের দিকে চেয়ে দেখো না;
আমার সমস্ত অন্যায় তুমি মাফ কর।” (জবুর ৫১:৯)
“আমার অন্তর নীরবে কেবল আল্লাহ্র অপেক্ষা করছে,
কারণ তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা।
কেবল তিনিই আমার উঁচু পাহাড় আর আমার উদ্ধার;
তিনিই আমার কেল্লা আমি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হব না।” (জবুর ৬২:১,২)
“হে মাবুদ, তুমি যদি অন্যায়ের হিসাব রাখ,
তবে হে মালিক, কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে?
…
ইয়ারমিয়া ৩৬:৩০ – একটি অপূর্ণ বিষ্যদ্বানী?
ইয়ারমিয়া ৩৬:৩০—“এই আয়াতে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে যে দাউদের সিংহাসনে বসবার জন্য যিহোয়াকীম কেউ থাকবে না, কিন্তু ২ বাদশাহ্নামা ২৪:৬ অনুযায়ী যিহোয়াকীমের মৃত্যুর পরে তার ছেলে যিহোয়াখীন তার জায়গায় বাদশাহ্ হলেন।”
এখানে কোন পরস্পর-বিরোধী কথা নাই, বরং মূল হিব্রু শব্দ “ইয়াশাব” ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইয়ারমিয়া ৩৬:৩০তে বলা হয়েছে যে যিহোযাকীমের পরে কেউ দাউদের সিংহাসনে “বসবে” (יושׁב “ইয়াশাব” ) না। এই ‘ইয়াশাব’ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয় “রয়ে যাওয়া”, “থাকা”, “বাস করা”, “প্রতিষ্ঠিত হওয়া”—অর্থাৎ স্থিতিশীল ভাবে সিংহাসনে বসা।
যিহোয়াকীমের ছেলে যিহোয়াখীন কোনভাবেই সিংহাসনে “ইয়াশাব” করেনি—কারণ তার রাজত্বকালের মাত্র তৃতীয় মাসে বখতে-নাসারের বাহিনী জেরুজালেম দখল করলেন এবং যেহোয়াখীনকে নির্বাসনে পাঠানো হল। অর্থাৎ যিহোয়াকীমের বংশধরে যে সিংহাসনে থাকবে না সেই ভবিষ্যদ্বানী আসলে পূর্ণ হয়েছিল ।
কোরআন শরীফের মধ্যে সেরকম জটিল একটি ভবিষ্যদ্বানী রয়েছে:
“রোমকগণ পরাজিত হইয়াছে—নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু উহারা উহাদের এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হইবে” (সূরা রূম ৩০:২,৩)
প্রসিদ্ধ কোরআন অনুবাদক ইউসুফ আলীর কথা অনুযায়ী, আরবী শব্দ “শীঘ্রই” (بِضع বিধু’উন) এর অর্থ ৩ থেকে ৯ বছর; অথবা ইসলামি ফাউন্ডেশন কোরআনের টিকা #১৩৩০ অনুযায়ী ৩-১০ বছর। হযরত মুহাম্মদ (সা) নিজেই বলেছিলেন যে “শীঘ্রই” বোঝাচ্ছে ৩ থেকে ৯ বছর (আল-বাইজাওয়ী)। পারস্য রাজ্য রোমীয়দের পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করেছেন ৬১৪ অথবা ৬১৫ সালে। কিন্তু বিখ্যাত ইসলামি ঐতিহাসিক আত-তাবারী এবং আল-বাইজাওয়ী অনুযায়ী পারস্যদের পরাজয় হল ১৩-১৪ বছর পরে (৬২৮ সালে)। মনে হচ্ছে ইয়ারমিয়ার উপরোক্ত জটিলতা থেকে এই জটিলতা কম না।
…
ইশাইয়া ৭:১৪ – কুমারীর সন্তান?
ইশাইয়া ৭:১৪—“এই ভবিষ্যদ্বানী পূর্ণ হয়নি, কারণ ‘আমলা’ শব্দার্থ অক্ষতযোনি স্ত্রীলোক নয় বরং কুমারী-বয়স, এবং ইঞ্জিল শরীফে ঈসাকে কেউ ‘ইমান্যুয়েল’ বলে ডাকেনি।”
এর প্রথম অভিযোগ- যে হিব্রু শব্দ עלמה আল্মা (জাকির নায়েকের কথামত “আম্লা” নয়!) শুধু যুব-বয়সী মেয়েকে বোঝায়, সেটা ঠিক না। হিব্রু ‘আল্মা’ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় একজন অক্ষতযোনি মেয়ে। যদি কোন নবী বলে যে একটি আশ্চর্য চিহ্ন দেখানো হবে, যে “একজন কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হবে”, এর অর্থ সবাই চিনতে পারে—বিনা সঙ্গমে মেয়েটি গর্ভবতী হবে। তাই ঈসা মসীহ্র ২০০ বছর আগেই যখন হিব্রু থেকে গ্রীক ভাষায় এই কিতাবের অনুবাদ করা হল, তখন তারা সঠিকভাবে এটা অনুবাদ করেছেন “παρθένος” (অবিবাহিতা সতী মেয়ে) দিয়ে।
এই আয়াত নিয়ে দ্বিতীয় অভিযোগ হল যে ছেলেটিকে বলা হবে “ইম্মানুয়েল”, অর্থাৎ “আমাদের সঙ্গে আল্লাহ্”। এই নাম যে মা মরিয়ম দিবে নাকি অন্য কেউ দিবে সেটা মূল হিব্রুতে অস্পষ্ট। কিন্তু ইঞ্জিলে ঈসাকে এই নাম দেওয়া হয়েছে (মথি ১:২৩), এবং ইতিহাস জুড়ে লক্ষ লক্ষ ঈসায়ী ঈসাকে “ইম্মানুয়েল” হিসাবে চেনে। তাই কোন অর্থে এটা অপূর্ণ ভবিষ্যদ্বানী হতে পারে?…
পিতার জন্য পুত্র দোষী?
হিজরত ২০:৫-৬—“পিতার গুনাহের জন্য সন্তানকে দায়ী করা অন্যায়”
শুরুতেই বলতে হয় যে তওরাতের শরিয়তের স্পষ্ট শিক্ষা হল যে রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে এবং কেয়ামতের বিচারের ক্ষেত্রে কোন মানুষ তার পিতার গুনাহের জন্য দোষী করা হবে না:শ
রাস্ট্রীয় আইন:
“ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদের হত্যা করা চলবে না। প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে।” (দ্বিতীয়বিবরণ ২৪:১৬)
কেয়ামতের বিচার: “যে গুনাহ্ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে।” (ইহিষ্কেল ১৮:২০)
প্রাচীন চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ম অনুযায়ী, একজন পিতার পাপের জন্য পুত্রকে শাস্তি দেওয়া যেত, তাই সেই সময়ের জন্য এটি খুব অগ্রগামী নিয়ম ছিল।
তাহলে হিজরত ২০:৫-৬ আয়াত কীভাবে আমরা ব্যাখ্যা করব?…
রংধনুর সৃষ্টি
পয়দায়েশ ৯:১৩—“বৈজ্ঞানিক দিক থেকে সেটা সম্ভব না যে শুধুমাত্র মহাবন্যার পরে আল্লাহ্ রংধনু সৃষ্টি করেছেন”
কিতাবুল মোকাদ্দসে তো কিন্তু কোন ইঙ্গিত নাই যে বন্যার আগে রংধনু ছিল না; অবশ্যই তা আগে থেকেই ছিল। আল্লাহ্ হযরত নূহ্কে বরং বলেছিলেন যে সেটা তার কাছে আল্লাহ্র প্রতিজ্ঞা মনে রাখার জন্য একটি বিশেষ চিহ্ন হবে যে তিনি আবার দুনিয়া সেভাবে ধ্বংস করবে না। তেমনই ভাবে পয়দায়েশ ১৫ অধ্যায়ে আল্লাহ্ হযরত ইবরাহিমকে তারা দেখিয়ে বলল যে সেটা তার জন্য একটি চিহ্ন হবে কত বংশধর তাকে দেওয়া হবে। তাতে কি আমরা বুঝবো যে তারাগুলো শুধু তখনই সৃষ্টি হয়েছিল?…
কোরবানী সম্পর্কে
সুন্নি শরীয়ত অনুযায়ী, কোরবানী দেওয়া ফরজ না বরং ওয়াজিব। কিন্তু ইরানে বলা হয় যে কোরবানী কেবন মক্কায় যারা হজ্জে যায় তাদের জন্য ওয়াজিব; তাই খুব কম লোক ইরানে কোরবানী দেয়। তাই ধর্মের ব্যাপারে অনেক মতবাদ আছে।
কোরবানী সম্পর্কে কোরআন শরীফে আমরা পড়ি:
“সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস!
…