হযরত পৌল এবং ইয়াকুব বিপরীত নয়?
ইয়াকুব—“নাজাতের ব্যাপারে হযরত পৌল এবং ইয়াকুব বিপরীত নয়?”
নাজাত আসে কাজের মাধ্যমে না ঈমানের মাধ্যমে? কিছু সমালোচক হযরত পৌল এবং ইয়াকুবের বিশেষ কিছু আয়াত নিয়ে দাবী করেন যে প্রথম ঈসায়ী নেতাদের মধ্যে এই ব্যাপারে অনেক অমিল ছিল। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফ ভালভাবে জানলে এই যুক্তি ভেঙ্গে যায়। হযরত পৌল এবং ইয়াকুবের সুসংবাদ বাণী এক ছিল, যদিও এরা শ্রোতাদের প্রয়োজন অনুসারে সুসংবাদের আলাদা অংশের উপর জোর দিতেন। তারা উভয় এই মূল বাণী বিশ্বাস করতেন:
শরিয়ত ভাল, কিন্তু তার মাধ্যমে কখনও নাজাত অর্জন করা সম্ভব না, যেহেতু মানুষ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তা পালন করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্ তার নাজাত এবং প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা প্রকাশ করেছেন—ঈসা মসীহ্। এই বিনামূল্য দান আল্লাহ্র কাছে গ্রহণ করতে হবে ঈমান দিয়ে, তওবা দিয়ে এবং তার উম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ভাল কাজ (শরিয়ত পালন) হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের চিহ্ন বা ফলাফল। একজনের “ঈমান”-এর ফলে যদি ভাল কাজ না আসে তাহলে বোঝা যায় এটি সত্যিকারের ঈমান ছিল না (এবং সেই ব্যক্তির নাজাত হবে না)। তাই ঈমান এবং কাজ দু’টোই প্রয়োজন, কিন্তু ঈমান হচ্ছে ভিত্তি।
পৌল এবং ইয়াকুব দু’জনেরই লেখাগুলি উপরোক্ত বাণীর সঙ্গে মিলে যায়। হযরত পৌল কি সত্যি শরিয়তকে “ঘৃণা” করেছিলেন যেমন করে সমালোচকরা দাবী করেন?…
“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”
“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”
হযরত পৌল এবং অন্যান্য সাহাবীদের মধ্যে যে কোন বড় ধরণের বিবাদ বা দ্বন্দ্ব ছিল তার জন্য ইঞ্জিলে কোন প্রমাণও নেই, ইঞ্জিলের বাইরে কোন স্বীকৃত ঐতিহাসিক দলিলেও কোন প্রমাণ নেই। সমালোচকেরা প্রেরিত ১৫:৩৯ আয়াতে হযরত পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে তর্কটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই আয়াত আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি:
কিছু দিন পরে পৌল বার্নাবাসকে বললেন, “যে সব জায়গায় আমরা মাবুদের কালাম তবলিগ করেছি, চল, এখনই সেই সব জায়গায় ফিরে গিয়ে ঈমানদার ভাইদের সংগে দেখা করি এবং তারা কেমন ভাবে চলছে তা দেখি।” তখন বার্নাবাস ইউহোন্নাকে সংগে নিতে চাইলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক বলেও ডাকা হত। পৌল কিন্তু তাঁকে সংগে নেওয়া ভাল মনে করলেন না, কারণ মার্ক পাম্ফুলিয়াতে তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের সংগে আর কাজ করেন নি। তখন পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে এমন মতের অমিল হল যে, তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। বার্নাবাস মার্ককে নিয়ে জাহাজে করে সাইপ্রাস দ্বীপে গেলেন, আর পৌল সীলকে বেছে নিলেন। তখন এণ্টিয়কের ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে মাবুদের রহমতের হাতে তুলে দিলে পর তাঁরা রওনা হলেন। পৌল সিরিয়া ও কিলিকিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সমস্ত জামাতগুলোর ঈমান বাড়িয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তুললেন। (প্রেরিত ১৫:৩৬-৪১)
এই ঘটনার আগে হযরত পৌল এবং বার্নাবাস দুই ভাই হিসেবে দীর্ঘদিনের একটি তবলিগ করেছিল একসাথে। উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে বিবাদের বিষয় মার্ককে সফরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নিয়ে। এটা কোন রকম ধর্মবিশ্বাসের বিবাদ ছিল না।
তার পরিবর্তে মজবুত প্রমাণ আছে যে এরা বিশ্বাসের ব্যাপারে একমত ছিল। যখন ৪৯ খ্রীষ্টাব্দে হযরত পৌল জেরুজালেমের ঈসায়ী নেতাদে্র সামনে তার বিশ্বাস এবং কাজের কথা বলেছিলেন, তখন এই সাহাবীরা খুশি হয়ে তাকে সম্পুর্ণভাবে গ্রহণ করলেন। হযরত পৌলের চিঠিগুলোর মধ্যে যে বিশ্বাস এবং সুসংবাদের কথা আছে, সেটা সাহাবী পিতর, সাহাবী ইয়াকুব এবং সাহাবী ইউহোন্নার চিঠিগুলোর মধ্যেও আছে। তারা ঈসায়ী মূল ‘সুসংবাদ’ বিশ্বাস নিয়ে একমত, যেটা এইভাবে সংক্ষিপ্ত করা যায়:
শুধু শরিয়ত পালন করার মাধ্যমে মানুষ নাজাত অর্জন করতে পারে না, কারণ তারা শরিয়ত পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পালন করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে তিনি একটি নাজাত, কাফফারা এবং পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেন হযরত ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে, যিনি একমাত্র নিষ্পাপ ব্যক্তি, “মনোনীত নাজাতদাতা”। তিনি ক্রুশে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করলেন এবং পুনরুত্থিত হলেন। এই নাজাতের দান কোন সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায় না বরং তওবা করে ঈসা মসীহ্র উম্মত হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়।
উপরোক্ত ‘সুসংবাদ’ শিক্ষাটি ইঞ্জিল শরীফের প্রত্যেকটি ২৭ খণ্ডে বার বার পাওয়া যায়। পুরো এই একই সুসংবাদের বাণী হযরত ঈসা মসীহ্ নিজেই বার বার বলেছেন— মথি ২৬:২৮; ইউহোন্না ৩:১৫, মথি ২০:২৮; মার্ক ১০:৪৫; ইউহোন্না ১০:৯; ইউহোন্না ১৪:৬; ইউহোন্না ৬:৪৪,৪৭,৪৮,৫১; ইউহোন্না ১০:১১; ইউহোন্না ১০:২৮; ইউহোন্না ১১:২৫; ইউহোন্না ১৭:১-২; ইউহোন্না ১৭:৩; লূক ২৪:২৬-২৭; লূক ৪:৪৩; ইউহোন্না ৬:২৯; ইউহোন্না ৬:৩৩,৩৫; ইউহোন্না ৪:১৪; ইউহোন্না ৫:২১; মথি ১৮:২১-৩৫। এই একই সুসংবাদ প্রচার করেছেন হযরত ঈসার উম্মত পিতর (প্রেরিত ২:৩৮; প্রেরিত ৪:১২; ১ পিতর ১:১৮-১৯; ২ পিতর ১:১৬), উম্মত ইয়াকুব (ইয়াকুব ২:১০), এবং উম্মত ইউহোন্না (১ ইউহোন্না ২:১,২)।
হযরত পৌলের জীবনী পড়লে বোঝা যায় যে তার বাণী থেকে তিনি কোন রকম দুনিয়াবী লাভ পাননি, অর্থাৎ মসীহ্ প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করার জন্য তার কোন কারণ ছিল না। হযরত পৌল যেভাবে প্রচার করতেন সেটা তার স্বার্থের বিপরীত ছিল। মসীহ্র উপর ঈমান আনার আগে তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল ছিল, তিনি বিখ্যাত আলেম গমলীয়েলের শিষ্য ছিলেন এবং রোমীয় নাগরিক ছিলনে (ইহুদীদের মধ্যে খুব কম লোকের এই সুবিধা ছিল)। মসীহ্র বাণী গ্রহণ না করলে তার নিশ্চয় মান-সম্মান, ধন এবং খ্যাতি অনেক থাকত। তিনি যদি ইহুদীদের কথামত বলতেন যে মসীহ্ কোন নাজাতদাতা নয় বরং শুধু একজন শরিয়ত-সমর্থক তাহলে সবাই তাকে পছন্দ করতেন এবং তার মান-সম্মান বেড়ে যেত। হযরত পৌল নিজেই লিখেছিলেন, “আমি যদি এখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করি তবে তো আমি মসীহের গোলাম নই।” (গালাতীয় ১:১০)।
মসীহ্র উপর ঈমান আনার আগে, হযরত পৌল ঈসায়ী জামাতের কঠিন শত্রু ছিলেন, তিনি ঈসায়ীদের ধরে তাদেরকে জেলখানায় ফেলে দিতেন (প্রেরিত ৯)। এইভাবে দামেষ্ক যাওয়ার পথে তিনি হঠাৎ মসীহ্র দর্শন পেয়েছিলেন। দুনিয়াবী স্বার্থের দৃষ্টি থেকে, তখন থেকেই তার জীবন পতন হল। ঈমান আনার পর থেকে তার জীবন কষ্টে ভরা ছিল। তাকে অত্যাচার ও মারধর করা হত, চাবুক দিয়ে আঘাত করত, পাথর ছুড়ে মারত, এবং তার জীবনে বিপদ, হুমকি, খিদে ও পিপাসার অভাব ছিল না (২ করিন্থীয় ১১:২৩-২৯)। তিনি অনেক বছর জেল কেটেছেন এবং সফরে জাহাজের দুর্ঘটনা ও ডাকাতের বিপদ সহ্য করেছিলেন। এই সময়ে তিনি কষ্ট করে চামড়ার কাজ করে আয় করতেন যেন কারো কাছে টাকা চাইতে না হয়। শেষে রোম শহরে তিনি শহীদ হলেন। এমন জীবনের এমন ব্যক্তি যে নিজ স্বার্থে মসীহ্র বাণী বিকৃত করেছেন, তা বলা বোকামি এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাসযোগ্য।
…