ইউহোন্না ৮:১-১১ – মূল ইঞ্জিলে অনুপস্থিত?

ইউহোন্না ৮:১-১১—“কিতাবুল মোকাদ্দস কীভাবে নির্ভরযোগ্য হতে পারে যেহেতু এই অনুচ্ছেদ সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে ছিল না?”

মাঝে মাঝে কিছু সমালোচকগণ এই অনুচ্ছেদ দেখিয়ে বলেন যে কিতাবুল মোকাদ্দস নির্ভরযোগ্য নয়, যেহেতু কিছু পাণ্ডুলিপিতে এটা লূকের শেষে পাওয়া যায় এবং অন্য কিছু পাণ্ডুলিপিতে এটা নাই। কিন্তু ইউহোন্না ৮:১-১১ এর নির্ভরযোগ্যতার পক্ষে আমাদের যথেষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ভাষা এবং স্টাইল ইউহোন্নার সঙ্গে ভালভাবে মিলে যায়, এবং ঘটনার ক্রমের মধ্যে মিলে যায়। আবার মনে রাখতে হবে যে এই দুই ছোট বিতর্কিত অনুচ্ছেদ (মার্ক ১৬:৯-২০ এবং ইউহোন্না ৮:১-১১) হচ্ছে কিতাবুল মোকাদ্দসের মাত্র ০.০০০৭% এবং এগুলো থাকলে বা না থাকলে কিতাবের শিক্ষার কোনো পরিবর্তন হয় না।

যারা এগুলো দিয়ে ইঞ্জিলের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্ন করেন, তারা বলে না যে কোরআনের ক্ষেত্রেও সেরকম সন্দেহজনক অংশ আছে। নবীজী (স) ইবন মাসঊদকে সম্মান করেছেন কোরআনের শ্রেষ্ঠ পাঠক হিসেবে—

আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী(স)-কে বলতে শুনেছি, চার ব্যক্তির নিকট থেকে তোমরা কোরআনের পাঠ গ্রহণ করঃ (১) ইবনে মাসউদ (২) আবু হুযাইফার মুক্ত গোলাম সালিম (৩) উবাই (ইবনে কা’ব) ও (৪) মুয়ায ইবনে জাবাল।” (সহীহ আল-বোখারী, ৩৫২৪ (জামে’ সহীহ্‌ আল-বোখারী অনুবাদ মাওলানা মোবারক করীম জওহর, খান ব্রাদার্স আণ্ড কোম্পানি, ৯ বাংলাবাজার ১১০০; ঢাকা ২০০৮, পৃষ্ঠা ৬৪৩)

এই ইবনে মাসউদ সূরা ফাতেহা, সূরা আল-ফালাক, এবং সূরা আন-নাস কোরআনের অংশ হিসেবে তিনি গ্রহণ করেননি। অপর দিকে, উপরোক্ত উবাই ইবনে কা’ব (রা)-এর মুসহাফে দু’টি বাড়তি সূরা ছিল—সূরা আল-হাফ্‌দ এবং সূরা আল-খাল’—
সূরা আল-হাফ্দ
সূরা আল-খাল

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা)-এর মুসহাফের সূরা আল-হাফ্দ এবং সূরা আল-খাল
(বর্তমান কোরআনে অনুপস্থিত)
আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের কথা অনুযায়ী, আলী ইবন আবি তালিবের কোরআনের মধ্যে “আল-খাফ্‌ধ” নামক একটি বাড়তি সূরা ছিল, যেটা আজকাল কোরআনে নাই। আবার বিভিন্ন শি’য়া উলেমাদের কথা অনুযায়ী, হযরত উসমান কোরআন শরীফ থেকে “সূরা উলায়াহ্‌” এবং “সূরা নুরাইন” নামক দু’টি সূরা বাদ দিয়েছেন।

হয়ত এইজন্য ‘আব্দুল্লাহ্‌ ইবন ‘ওমর (মৃঃ৬৯২) বলেছেন, “কেউ না বলুক, ‘আমি পুরো কোরআন শিখেছি!’…

ইউহোন্না ৫:৩১ – নিজের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য?

ইউহোন্না ৫:৩১—“নিজের বিষয়ে ঈসা মসীহ্‌র সাক্ষ্য সত্যি (ইউহোন্না ৮:১৪) নাকি সত্যি নয় (৫:৩১)?”

প্রথম অনুচ্ছেদে (৫:৩১), ঈসা মসীহ্ আলোচনার জন্য ইহুদী নিয়ম মেনেছেন, যে কোন কিছু প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একাধিক সাক্ষ্যর দরকার (দ্বিতীয়বিবরণ ১৯)। এই যুক্তি মেনে তিনি বলছেন যে তার পক্ষে ইয়াহিয়া (যাকে এরা সম্মান করেন) এবং পাক-কিতাব দুজনই সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে (৮:১৪), তিনি বলছেন যে তা হলেও, তার নিজের সাক্ষ্য যথেষ্ট কারণ তিনি এক আল্লাহ্‌র জীবন্ত কালাম (ইউহোন্না ১:১), তিনিই সত্য (ইউহোন্না ১৪:৪) এবং তিনি মসীহ্।

তাই পঞ্চম অধ্যায় তিনি বলছেন যে মানুষের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার আত্মসাক্ষ্য অবৈধ হলেও, আমার পক্ষে আরও সাক্ষ্য রয়েছে…” কিন্তু ৮ অধ্যায়ে তিনি তার আত্মসাক্ষ্য বৈধতা প্রমাণ করেন। এখানে কোন পরস্পর-বিরোধী নেই।

ইউহোন্না ১:২১ – ইয়াহিয়া কি ইলিয়াস ছিলেন?

ইউহোন্না ১:২১—“তরিকাবন্দিদাতা ইয়াহিয়া কি ইলিয়াস ছিলেন (মথি ১১:১৪; ১৭:১৭:১০-১৩) নাকি তিনি ইলিয়াস ছিলেন না (ইউহোন্না ১:২১)?”

তরিকাবন্দিদাতা ইয়াহিয়া আক্ষরিক অর্থ ইলিয়াসের অবতার অবশ্যই ছিলেন না, কিন্তু তিনি নবী মালাখি এবং জিবরাইলের ভবিষ্যদ্বানী পূরণ করেছেন যে ইলিয়াসের মত একজন নবী এসে মসীহ্র পথ প্রস্তুত করবেন। ইয়াহিয়ার জন্মের আগে, জিব্রাইল ইয়াহিয়ার পিতা জাকারিয়ার কাছে এসে বললেন যে তার সন্তান “নবী ইলিয়াসের মত মনোভাব ও শক্তি নিয়ে সে মাবুদের আগে আসবে…লোককে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করবে।” (লূক ১:১৭)। জিব্রাইলের কথা অনেকটা নবী মালাখির কথা মত, যে মাবুদের দিনের আগে একজন ইলিয়াস এসে তার পথ প্রস্তুত করবে।

ফরীশীগণ এই ভবিষ্যদ্বানী ভুলব্যাখ্যা করে মনে করতেন যে ইলিয়াস নিজেই ফিরে আসবেন। তাই ইয়াহিয়া তাদের খুলাখুলি বললেন, যে তিনি সেই আক্ষরিক অর্থে ইলিয়াস নন। ঈসা মসীহ্ বরং বুঝতে পেরেছেন যে ইয়াহিয়া সেই ভবিষ্যদ্বানী পূরণ করেন যে ইলিয়াসের মত একজন আসবেন।

কোরআন শরীফে তেমন ধরনের জটিলতা রয়েছে। কোরআনের কিছু কিছু আয়াত কোন সাফায়াত পুরোপুরি অস্বীকার করেন (২:১২২-১২৩; ২:২৫৪; ৬:৫১; ৮২:১৮-১৯), আবার কিছু আয়াতে বলা হয় যে সাফায়াত সম্ভব হতে পারে (২০:১০৯; ৩৪:২৩; ৪৩:৮৬; ৫৩:২৬)।

লূক ১৪:২৬ – বাবা-মাকে ঘৃণা করা?

লূক ১৪:২৬—“ঈসা মসীহ্‌ কি এখানে বাবা-মাকে ঘৃণা করতে বলেছিলেন?”

উপরোক্ত প্রশ্ন থেকে বোঝা যায় সমালোচক প্রাচীন সাহিত্যের সাথে অপরিচিত। এই rhetorical device-কে বলা হয় hyperbole, এবং প্রাচীন লেখায় তা খুব বেশী দেখা যায়। ঈসা মসীহ্‌র যুগে সবাই বুঝেছিল যে তিনি আক্ষরিক ‘ঘৃণা’ বলেননি বরং “তুলনামূলক ভাবে চেয়ে কম ভালবাসা”। কিতাবুল মোকাদ্দেসের অন্যান্য জায়গায় এই hyperbole –এর উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে সুস্পষ্টই আক্ষরিক ঘৃণার কথা বলা হচ্ছে না বরং শুধু “তুলনামূলক ভাবে কম মহব্বত করা”, যেমন পয়দায়েশ ২৯:৩০-৩১। আরেকটি উদাহরণ আছে লূক ১৬:১৩:

“কোন গোলাম দু’জন কর্তার সেবা করতে পারে না, কারণ সে একজনকে ঘৃণা করবে ও অন্যজনকে ভালবাসবে, কিংবা সে একজনের প্রতি মনোযোগ দেবে ও অন্যজনকে তুচ্ছ করবে। আ্লাহ্ ও ধন-সম্পত্তি এই দু’য়েরই সেবা তোমরা একসংগে করতে পার না।” (লূক ১৬:১৩)

এখানে অবশ্যই আক্ষরিক ঘৃণা বোঝানো হচ্ছে না, কারণ তিনি সাধীনভাবে দু’জন মালিক পছন্দ করার কথা বলছেন। এই hyperbole–এর আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায় গ্রীক লেখা কোর্পুস হের্মেটিকুম থেকে:

“প্রিয় সন্তান, প্রথমে নিজের শরীরকে ঘৃণা না করলে নিজেকে মহব্বত করতে পারবে না” (পইমান্দ্রেজ ৪:৬)

Poetae Lyrici Graeci বইয়ের একটি যুদ্ধের গানে বলা হয়েছে যে মানুষ:

“স্পার্টা শহরের মর্জাদার জন্য নিজের জীবনকে নিজের শত্রু মনে করতে হবে”

এখানে আক্ষরিক ঘৃনা বলা হচ্ছে?…

লূক ৩:৩৫-৩৬—“কীনান নাকি আরফাখশাদ?”

লূক ৩:৩৫-৩৬—“শালেখের আব্বা কীনান (লূক ৩:৩৫) নাকি আরফাখশাদ (পয়দায়েশ ১১:১২)?”

এটা দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকে বলেন যে পয়দায়েশে “জন্ম দেওয়া” এবং “পিতা” বোঝাতে হয় শুধু পিতা নয় বরং পিতার পিতা বা দাদা, এবং তাই কীনান ছিলেন শালেখের পিতা এবং আরফাখশাদ ছিলেন এর দাদা। এর সমর্থনে তওরাতের গ্রীক পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী আরফাখশাদের বয়স ১৩৫ বছর ছিল যখন শালেখের জন্ম হয়।

আবার অনেকে বলেন যে লূক কিতাবের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মত বাড়তি কীনান দেওয়া উচিত না। এর সমর্থনে ঐতিহাসিক ফ্লাভিয়ুস যোসেফুস এবং জুলিয়স আফ্রিকানুস তাদের বংশতালিকায় দ্বিতীয় কীনান বাদ দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একজন প্রাচীন লেখক কিতাবের অনুলিপি করতে গিয়ে ভুল করে কীনানের নাম দুই বার লিখেছেন।

    ১.

লূক ১:৩২ – মসীহ্‌ কি দাউদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী?

লূক ১:৩২—“এই আয়াতের কথায়, ঈসা মসীহ্‌ ছিলেন বাদশাহ্‌ দাউদের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, কিন্তু ঈসা মসীহ্‌র পুর্বপুরুষ যিকনিয় (মথি ১:১১) বংশধরের শেষ রাজা হয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন (ইয়ারমিয়া ৩৬:৩০), তাই সেই সূত্র অবৈধ ।”

হযরত ঈসা মসীহ্‌র বংশ শুধু তার পিতা ইউসুফের মাধ্যমে নয় বরং তার মা মরিয়মের মধ্যেও (লূকের বংশতালিকা), এবং সেটা যিকনিয় ছাড়া অন্য এক লাইনে। আল্লাহ্‌র ফেরেশতা জিবরাইল আবার এই লাইনের বৈধতা সমর্থন করে বলেছেন: “মাবুদ আল্লাহ্ তাঁর পূর্বপুরুষ বাদশাহ্ দাউদের সিংহাসন তাঁকে দেবেন” (লূক ১:৩২)।

মার্ক ১৬:১৪-১৮ – প্রকৃত ঈসায়ী হওয়ার পরীক্ষা?

মার্ক ১৬:১৪-১৮—“এই আয়াতের পরীক্ষা অনুযায়ী, একজন প্রকৃত ঈসায়ী হতে হলে সব ভাষায় কথা বলতে হবে এবং বিষ খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে।”

ইঞ্জিলের সমালোচকগণ হযরত ঈসা মসীহ্র এই কথা ভুলব্যাখ্যা করে সেটাকে একটি পরীক্ষা বানিয়েছে – প্রকৃত ঈসায়ী হতে হলে, এই চ্যালেঞ্জে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু একই যুক্তি অনুযায়ী, মুসলমানদের জন্য তেমন একটা ‘পরীক্ষা’ রয়েছে – হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, “যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।” – অর্থাৎ এই যুক্তিতে, যারা জীবনে একবারও মুখ খুলে, তারা জাহান্নামী। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে আসল ব্যাখ্যা হচ্ছে যে প্রকৃত ঈমানদারের জীবনে এই ধরনের প্রবণতা বেশী দেখা যায় (চুপ থাকা, বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা এবং বিষ খেয়ে বেঁচে থাকা)।

এই আয়াতে বলা হয়নি যে প্রত্যেক ঈমানদারের মধ্যে এই অলৌকিক গুণ সবসময় দেখা যাবে, বরং বলা হচ্ছে যে ঈমানদারদের মধ্যে এই চিহ্ন দেখা যাবে। এটা নিশ্চয় কোনো ‘falsification test’ (δοκιμάζω) নয়। তার সাহাবীদের জন্য একটি প্রতিজ্ঞা হিসেবে ঈসা মসীহ্ এই কথা বলেছেন, যে শয়তান যাই করেন না কেন, তিনি ঈমানদারদের উপর জয়লাভ করবেন না। প্রথম ঈসায়ী জামাতের মধ্যে এই চিহ্ন দেখা দিয়েছে – হযরত পৌলকে একটি বিষাক্ত সাপ কামড়াল কিন্তু তার ক্ষতি হয়নি (প্রেরিত ২৮:৩-৯) এবং প্রথম জামাতের উদ্বোধনে ১২জন সাহাবী অলৌকিকভাবে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছিলেন যখন পাক-রূহ্ তাদের উপর নেমে গেলেন। আমরা ইঞ্জিল শরীফ থেকে জানি যে বিভিন্ন ভাষা কথা বলার রূহানী দান সবাইকে দেওয়া হয়নি (১ করিন্থীয় ১২:১০); তেমনই ভাবে অন্যান্য চিহ্ন প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য নয়।

দ্বিতীয়ত, লোক দেখানোর জন্য আল্লাহ্ তাৎক্ষণিক কেরামতী করেন না। যখন মরুভূমিতে শয়তান হযরত ঈসার কাছে একটি “falsification test”-এর দাবী করলেন, ঈসা মসীহ্ কিতাবের তৌরাত শরীফের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তর দিলেন, “তোমার মাবুদ আল্লাহ্কে তুমি পরীক্ষা করতে যেয়ো না।” (মথি ৪:৭; মথি ১৬:৪)। আবার ইহুদী নেতারা যখন ঈসাকে একটি চিহ্ন দেখাতে বলল, তিনি তাদের কোন চিহ্ন দেখাতে চাননি। তিনি অবশ্যই অনেক চিহ্ন দেখাতে পারতেন (এবং অন্যান্য সময়ে তিনি প্রায়ই কেরামতী কাজ করতেন), কিন্তু লোক দেখানোর চিহ্ন করেননা। তেমনভাবেও হযরত মুহাম্মদের সমালোচকগণ তাকে একটি কেরামতী কাজ দেখাতে বলল, কিন্তু তিনি কখন তা করেননি। ঈসা মসীহ্র শিক্ষা অনুযায়ী, কেরামতী কাজ দ্বারা ঈমানদার এবং অ-ঈমানদার বোঝা যায় না, কারণ—

“…অনেক ভণ্ড মসীহ্ ও ভণ্ড নবী আসবে এবং বড় বড় চিহ্ন-কাজ ও কুদরতি দেখাবে যাতে সম্ভব হলে আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদেরও তারা ঠকাতে পারে।” (মথি ২৪:২৪)

অর্থাৎ ঈসা মসীহ্ এই ধরণের ঈমানের পরীক্ষা সমর্থন করেননি।

তৃতীয়তঃ, “নতুন ভাষা” এবং “সব ভাষা” এক না। মার্ক ১৬:১৭ আয়াতে “καιναι” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ “অজানা, নতুন”। অনেকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেটা বোঝাচ্ছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তবলিগ করতে গিয়ে নতুন ভাষা শিক্ষার গুণ। অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটা হচ্ছে একটি পুরোপুরি রূহানিক দান বা ‘বেহেশতি ভাষা’ যা আল্লাহ্ দান করেন।

মার্ক ১৬:৯-২০ – মূল ইঞ্জিলে কি ছিল?

মার্ক ১৬:৯-২০—“এই অনুচ্ছেদ যেহেতু সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোতে ছিল না, সেহেতু ইঞ্জিল শরীফ কীভাবে নির্ভরযোগ্য হতে পারে?”

ইঞ্জিলের সমালোচকগণ প্রায়ই মার্ক ১৬:৯-২০ এবং ইউহোন্না ৮:১-১১ দিয়ে “প্রমাণ” করেন যে বাইবেল পরিবর্তিত এবং অনির্ভরযোগ্য, যেহেতু ইঞ্জিলের কিছু কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এই দুই অনুচ্ছেদ বাদ থাকে। কিন্তু মার্ক ১৬:৯-২০ যে মূল লেখার মধ্যে ছিল তা বিশ্বাস করার অনেক কারণ রয়েছে, কারণ অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মধ্যে তা রয়েছে এবং প্রাচীন ঈসায়ী জামাতের নেতা ইরেন্যাউস( মৃঃ ২০০) এর উল্লেখ করেছেন। এই অনুচ্ছদ বাদে মার্ক খণ্ডটি অস্বাভাবিকভাবে শেষ হত, বরং এই অনুচ্ছেদ দিয়ে তা স্বাভাবিকভাবে সমাপ্ত হয়। আবার মার্ক ১৬:৯-২০ ও ইউহোন্না ৮:১-১১ অনুচ্ছেদগুলি গোটা ইঞ্জিলের তুলনায় যথার্থ গুরুত্ব দিতে হয়-পুরো কিতাবুল মোকাদ্দসে মাত্র এই দুই সামান্য অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলো হচ্ছে কিতাবুল মোকাদ্দসের শতকরা ০.০০০৭% ভাগ মাত্র।

একই সমালোচকগণ প্রায়ই অবহেলা করেন যে কোরআন শরীফ নিয়েও তেমন ধরণের প্রশ্ন রয়েছে। নবীজী ইবনে মাসউদকে একজন শ্রেষ্ঠ কোর’আন পাঠক বলতেনঃ

আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী(স)-কে বলতে শুনেছি, চার ব্যক্তির নিকট থেকে তোমরা কোরআনের পাঠ গ্রহণ করঃ (১) ইবনে মাসউদ (২) আবু হুযাইফার মুক্ত গোলাম সালিম (৩) উবাই (ইবনে কা’ব) ও (৪) মুয়ায ইবনে জাবাল।” (সহীহ আল-বোখারী, ৩৫২৪ (জামে’ সহীহ্‌ আল-বোখারী অনুবাদ মাওলানা মোবারক করীম জওহর, খান ব্রাদার্স আণ্ড কোম্পানি, ৯ বাংলাবাজার ১১০০; ঢাকা ২০০৮, পৃষ্ঠা ৬৪৩)

এই ইবনে মাসউদ সূরা ফাতেহা, সূরা আল-ফালাক, এবং সূরা আন-নাস কোরআনের অংশ হিসেবে তিনি গ্রহণ করেননি। অপর দিকে, উপরোক্ত উবাই ইবনে কা’ব (রা)-এর মুসহাফে দু’টি বাড়তি সূরা ছিল—সূরা আল-হাফ্‌দ এবং সূরা আল-খাল’:

Sura al-Hafd

সূরা আল-হাফ্দ

Sura al-Khal

সূরা আল-খাল

হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা)-এর মুসহাফের সূরা আল-হাফ্দ এবং সূরা আল-খাল
(বর্তমান কোরআনে অনুপস্থিত)
আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের কথা অনুযায়ী, আলী ইবন আবি তালিবের কোরআনের মধ্যে “আল-খাফ্‌ধ” নামক একটি বাড়তি সূরা ছিল, যেটা আজকাল কোরআনে নাই। আবার বিভিন্ন শি’য়া উলেমাদের কথা অনুযায়ী, হযরত উসমান কোরআন শরীফ থেকে “সূরা উলায়াহ্‌” এবং “সূরা নুরাইন” নামক দু’টি সূরা বাদ দিয়েছেন।

হয়ত এইজন্য ‘আব্দুল্লাহ্‌ ইবন ‘ওমর (মৃঃ৬৯২) বলেছেন, “কেউ না বলুক, ‘আমি পুরো কোরআন শিখেছি!’…

মথি ২১:১২ – ঈসা মসীহ্‌ কোন্‌ দিনে বাইতুল মোকাদ্দসে গিয়েছিলেন?

মথি ২১:১২—“ঈসা মসীহ্‌ কোন্‌ দিনে বাইতুল মোকাদ্দসে বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলেন—জেরুজালেমে ঢুকবার প্রথম দিনে (মথি ২১:১২) নাকি দ্বিতীয় দিনে (মার্ক ১১:১-১৭)?” এবং ডুমুর গাছটি তিনি কখন ধমক দিলেন? (দেখুন মার্ক ১১:১২)”

ঘটনাগুলো এই ক্রমে ঘটেছে:

প্রথম দিনে : ঈসা মসীহ্‌ একটি গাধার পিঠে করে জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন, অল্পক্ষণের জন্য বাইতুল মোকাদ্দসে গেলেন, এবং সন্ধ্যায় আবার বেথানিয়া গ্রামে ফিরে গেলেন।

দ্বিতীয় দিন : ঈসা মসীহ্‌ ভোরে উঠে জেরুজালেমে যাওয়ার পথে ডুমুর গাছটিকে ধমক দিলেন, এবং তারপর বাইতুল মোকাদ্দসে বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলেন।

মার্ক এবং লূকে এটা বেশ পরিষ্কার, কিন্তু মথি তার লেখায় বাইতুল মোকাদ্দসের ঘটনা রাখলেন জেরুজালেম প্রবেশ এবং ডুমুর গাছের ঘটনাগুলোর মাঝখানে। মথিতে এইভাবে আছে কারণ এই সমাচারে ঘটনাগুলো সাজানো হয়েছে প্রধানত বিষয় অনুসারে, সময়ের ক্রম অনুসারে নয়। অন্যান্য অনেক প্রাচীন লেখায় এইভাবে করা হয়। ঈসা মসীহ্‌র জেরুজালেম প্রবেশ এবং বাইতুল মোকাদ্দস পরিষ্কার করার ঘটনাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মথি এখানে দেখাতে চাচ্ছিলেন, যার কারণে তিনি মাঝখান থেকে ডুমুর গাছের ঘটনা সরিয়ে দিলেন।

মথি ২১:৭ – কয়টা গাধা?

মথি ২১:৭—“ঈসা মসীহ্‌ কি একটা গাধা ও গাধীর বাচ্চার পিঠে করে জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন নাকি শুধু একটি গাধা ছিল যেমন মার্ক ১১:৭ এবং লূক ১৯:৩৫-এ আছে?”

মার্ক এবং লূক শুধু উল্লেখ করেছেন যে গাধীর বাচ্চা উপর ঈসা চড়ল, কিন্তু মথি এ-ও উল্লেখ করেছিলেন যে সেই গাধীর বাচ্চা শান্ত রাখার জন্য তার মা সঙ্গে করে নিয়ে নেয়া হল। জাকারিয়া ৯:৯ এর ভবিষ্যদ্বানী পূরণ করার জন্য ঈসা মসীহ্ ইচ্ছাকৃতভাবে গাধীর বাচ্চার উপরে চড়ে আসলেন।