ইশাইয়া ১১:১২ – পৃথিবীর ‘চার কোণ’?
ইশাইয়া ১১:১২—“এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পৃথিবী সমতল, নাহলে ‘চার কোণ’ থাকত না”
…আর তিনি জাতিগণের নিমিত্ত পতাকা তুলিবেন, ইস্রায়েলের তাড়িত লোকদিগকে একত্র করিবেন, ও পৃথিবীর চারি কোণ হইতে যিহূদার ছিন্নভিন্ন লোকদিগকে সংগ্রহ করিবেন।
(ইশাইয়া ১১:১২)
এখানে “চারি কোণ” দিয়ে যে শুধু “চারদিক থেকে” (উত্তর, দক্ষীণ, পূর্ব, পশ্চিম) বোঝানো হচ্ছে তা খুবই স্পষ্ট। “কোণ” এর মূল হিব্রু শব্দ হল כּנף কানাফ , কার অন্য অনুবাদ “প্রান্ত”, “পোয়া”, সীমা”, এমনকি “পাখা”। প্রাচীনকালে যারা মনে করতে যে পৃথিবী সমতল, তারা আবার মনে করত যে পৃথিবী থালার মত গোল, তাই আক্ষরিকভাবে “কোণ” ব্যাখ্যা করলেও সেটা প্রাচীন কালের সমতল ধারণার সঙ্গে মিলে না। “চারি কোণ থেকে” শুধু “চারদিক থেকে”-এর একটি চলতি কথা। এমনকি বাইবেল সমালোচক আহমেদ দীদাত নিজেই তার লেখায় এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন – “to the four corners of the globe”.…
ইশাইয়া ৭:১৪ – কুমারীর সন্তান?
ইশাইয়া ৭:১৪—“এই ভবিষ্যদ্বানী পূর্ণ হয়নি, কারণ ‘আমলা’ শব্দার্থ অক্ষতযোনি স্ত্রীলোক নয় বরং কুমারী-বয়স, এবং ইঞ্জিল শরীফে ঈসাকে কেউ ‘ইমান্যুয়েল’ বলে ডাকেনি।”
এর প্রথম অভিযোগ- যে হিব্রু শব্দ עלמה আল্মা (জাকির নায়েকের কথামত “আম্লা” নয়!) শুধু যুব-বয়সী মেয়েকে বোঝায়, সেটা ঠিক না। হিব্রু ‘আল্মা’ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় একজন অক্ষতযোনি মেয়ে। যদি কোন নবী বলে যে একটি আশ্চর্য চিহ্ন দেখানো হবে, যে “একজন কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হবে”, এর অর্থ সবাই চিনতে পারে—বিনা সঙ্গমে মেয়েটি গর্ভবতী হবে। তাই ঈসা মসীহ্র ২০০ বছর আগেই যখন হিব্রু থেকে গ্রীক ভাষায় এই কিতাবের অনুবাদ করা হল, তখন তারা সঠিকভাবে এটা অনুবাদ করেছেন “παρθένος” (অবিবাহিতা সতী মেয়ে) দিয়ে।
এই আয়াত নিয়ে দ্বিতীয় অভিযোগ হল যে ছেলেটিকে বলা হবে “ইম্মানুয়েল”, অর্থাৎ “আমাদের সঙ্গে আল্লাহ্”। এই নাম যে মা মরিয়ম দিবে নাকি অন্য কেউ দিবে সেটা মূল হিব্রুতে অস্পষ্ট। কিন্তু ইঞ্জিলে ঈসাকে এই নাম দেওয়া হয়েছে (মথি ১:২৩), এবং ইতিহাস জুড়ে লক্ষ লক্ষ ঈসায়ী ঈসাকে “ইম্মানুয়েল” হিসাবে চেনে। তাই কোন অর্থে এটা অপূর্ণ ভবিষ্যদ্বানী হতে পারে?…
সোলায়মান – আল্লাহ্র কালামে ‘অশ্লীল কথা’?
সোলায়মান—“আল্লাহ্র কালামে এমন ধরনের অশ্লীল কথা থাকতে পারে না”
আল্লাহ্র কালামে জীবনের সমস্ত বিষয়ের জন্য হেদায়েত আছে। সোলায়মান কিতাব হল স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে প্রেমের একটি কবিতা, এবং এর মধ্যেকার সমস্ত বর্ণনা বিবাহের মধ্যে উপযুক্ত। এই কিতাবের দুই ব্যক্তির ‘প্রিয়’ এবং ‘প্রিয়া’ নাম থেকে বোঝা যায় এরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। কবিতা মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে “স্ত্রী” বলেননি বরং তাকে “প্রিয়া” করে ডাকলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে সেটা কি খারাপ না ভাল?…
মেসাল ৬:৭ – পিপিলিকাদের নেতা বা মজুরসরদার আছে?
মেসাল ৬:৭—“এই আয়াত অনুযায়ী পিপিলিকাদের কোন নেতা বা মজুরসরদার নাই, কিন্তু তাদের রাণী ও মজুরসরদার আছে।”
পিঁপড়াদের “হুকুম দেবার কেউ নেই,
তার উপরে কোন পরিচালক বা শাসনকর্তা নেই” (মেসাল ৬:৭)
নায়েক বলেন যে সেটা বিজ্ঞান বিপরীত, কারণ পিঁপড়াদের মধ্যে একজন রানী থাকে এবং মজুরসরদার থাকে। পিঁপড়া সমাজের সম্পর্কে অল্প একটু গবেষণা করলে জানা যায়, পিঁপড়ার ‘রানী’ কোন রকম নেতা নয়। একটি উইকিপিডিয়া এইভাবে বর্ণনা করেছেন—
“The term “queen” is often deceptive, as the queen ant has very little control over the colony as a whole.
…
পৃথিবীর কি ধ্বংস হবে নাকি চিরকাল থাকবে?
জবুর ১০২:২৬—“এখানে বলা হয়েছে যে পৃথিবী ধ্বংস হবে না, কিন্তু জবুর ৭৮:৬৯ তার বিপরীত কথা লেখা আছ।”
অভিযোগটা হল যে জবুর ১০২:২৬ এবং ইবরানী ১:১১ বলা হয়েছে যে আসমান জমীন ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু হেদায়েতকারী ১:৪ এবং ৭৮:৬৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে দুনিয়া চিরকাল থাকবে। কেমন করে দু’টোই ঠিক হতে পারে?…
পৃথিবী কি স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে?
জবুর ৯৩:১—“এখানে বলা হয়েছে যে পৃথিবী স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞান অনুযায়ী পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।”
এখানে “পৃথিবী” শব্দের ভুলব্যাখ্যা হয়েছে, কারণ “পৃথিবী” (হিব্রু תּבל তেবেল এবং ארץ ‘এরেত্স ) দিয়ে সাধারণত আমাদের পুরো গ্রহ বোঝানো হয় না বরং “দেশ”, “মহাদেশ” বা “জমিন” বা “এলাকা” বোঝানো হয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্র সার্বভৌম ক্ষমতায় জমিন মোটামুটি স্থিতিশীল ও স্থায়ী।
…
আইয়ুব ৪১:১ – রূপকথার কাল্পনিক জীব?
আইয়ুব ৪১:১—“এখানে একটি রূপকথার কাল্পনিক জীবের বর্ণনা কেমন করে থাকতে পারে?”
কিতাবুল মোকাদ্দসে মাঝে মাঝে শয়তানকে তুলনা করা হয় বিভিন্ন রূপকথার জন্তুর সঙ্গে যেমন ‘দানব’ (প্রকাশিত কালাম ১২:৯) বা “লিবিয়াথন” (ইশাইয়া ২৭:১)। এমন আয়াতে বলা হয় না যে সেসব জন্তু বাস্তব, বরং সেগুলোতে শুধু শয়তানের খারাপ বৈশিষ্ট্য কিছু পরিচিত ভয়ংকর জন্তুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। আইয়ুব কিতাবে এইসব আয়াত হয়ত এমন করা হচ্ছে, আল্লাহ্র সর্বশক্তিমান ক্ষমতা কাল্পনিক জন্তুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
আইয়ুব ৪০:১৫-২৪ আয়াতের “বেহেমোৎ” নিঃসন্দেহে এক রকম বড় বুনো ষাঁড় বা জলহস্তী। অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারী মনে করেন যে আইয়ুব ৪১:১-৩৪ আয়াতের “লিবিয়াথন” হচ্ছে একটি বড় কুমির। আবার হয়ত বোঝানো হচ্ছে একটি প্রাচীন লুপ্ত প্রাণী। কিছুদিন আগে বৈজ্ঞানীকেরা একটি প্রাচীন ৪৩-ফুট লম্বা ও ১০০০-কিলোগ্রাম ওজনের সাপের হাড় খুঁজে পেয়েছে, যে কুমির খেত এবং ডাইনোসরদের অনেক পরে লুপ্ত হয়েছিল। আইয়ুব কিতাবে এই প্রাণীদের প্রাচীনত্ব উল্লেখ হয়েছে ৪০:১৯ আয়াতে: “আল্লাহ্র সৃষ্টির মধ্যে তার স্থান প্রধান”।
কোরআন শরীফে আমরা পড়ি যে হযরত সোলায়মান একটি ‘ইফ্রিত’-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন (সূরা নাম্ল ২৭:১৫-৪৪)। বিখ্যাত কোরআন অনুবাদক মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ বলেন যে ‘ইফ্রিত’ হচ্ছে “একটি মন্দ শয়তান যেটা বিভিন্ন রূপকথায় পাওয়া যায়”। Encyclopedia Britannica এর সজ্ঞা অনুযায়ী, ‘ইফ্রিত’ হচ্ছে ধোঁয়ার তৈরী একটি বড় পাখাওয়ালা জন্তু যারা মাটির নিচে বাস করে। আবার মি’রাজে নবীজী ‘আল-বুরাক’ নামে একটি সাদা পাখাওয়ালা অশ্ব চড়েছিলেন। এই দুই জন্তুর অস্তিত্ব নিয়ে কোন সমস্যা না থাকলে কিতাবুল মোকাদ্দসের বুনো ষাঁড়ের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকার কথা নয়।
…
আইয়ুব ২৬:১১ – আকাশের স্তম্ভ?
আইয়ুব ২৬:১১—“এই আয়াত বলে যে আকাশের স্তম্ভ রয়েছে”
আইয়ুব কিতাব একটি কাব্যিক লেখা, যার কারণে এতে অনেক রূপক, অলংকারবহুল ও অত্যুক্তিময় ভাষা আছে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি আইয়ুব আক্ষরিক অর্থ মনে করেনি যে আকাশের স্তম্ভ আছে, কারণ কয়েক আয়াত আগে তিনি বলেছিলেন—
তিনি শূন্যে উত্তরের আসমান বিছিয়ে দিয়েছেন;
শূন্যের মধ্যে দুনিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। (আইয়ুব ২৬:৭)
অর্থাৎ আইয়ুব জানতেন যে আসমান শূন্যের উপর ঝুলছে, আবার তিনি জানতেন যে পুরো দুনিয়া শূন্যের উপর ঝলছে। সমালোচক যদি এই সব প্রমাণ গ্রহণ না করে, তাহলে মনে রাখতে হয় যে আইয়ুব কিতাবের শেষে আল্লাহ্ হযরত আইয়ুবকে ধমক দেয় সৃষ্টি সম্পর্কে “জ্ঞানহীন কথা” বলার জন্য (আইয়ুব ৩৮:১-৪)। এর পর হযরত আইয়ুব তওবা করেন, এবং আল্লাহ্ তাকে সম্মান করেন।
উল্লেখ্য যে কোরআন শরীফেও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে, এবার উল্কাপিণ্ড নিয়ে:
“আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজির সুষমা দ্বারা সুশোভিত করিয়াছি, এবং রক্ষা করিয়াছি প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান হইতে। ফলে উহারা উর্ধ্ব জগতের কিছু শ্রবণ করিতে পারে না এবং উহাদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় সকল দিক হইতে- বিতাড়নের জন্য এবং উহাদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি। তবে কেহ হঠাৎ কিছু শুনিয়া ফেলিলে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড তাহার পশ্চাদ্ধ্বাবন করে। (সূরা সাফফাত ৩৭:৬-১০)
…
আইয়ুব ১০:৯-১০ – মানুষ পনিরের মত তৈরি?
তৈরি হয়েছে।”
এই উদ্ধৃতি হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতি আইয়ুবের অভিযোগের একটি অংশ, যেখানে আইয়ুব ভুল করে দাবি করেছেন যে তিনি আল্লাহ্র গোপন কথা জানেন। কিন্তু আল্লাহ্ তাকে এইভাবে সমালোচনা করেছেন:
তখন মাবুদ ঝড়ের মধ্য থেকে আইয়ুবকে জবাব দিলেন। তিনি বললেন, “এ কে, যে জ্ঞানহীন কথা দিয়ে আমার পরিকল্পনাকে সন্দেহ করে?
…
আইয়ুব ৯:৬ – সমতল পৃথিবীর নিচে থাম?
আইয়ুব ৯:৬—“এই আয়াত অনুযায়ী পৃথিবীর থাম আছে, অর্থাৎ পৃথিবী সমতল।”
এই সব আয়াত কোন ভূতাত্ত্বিক বর্ণনা নয় বরং কাব্যিক ভাষা ও উপমা দিয়ে আল্লাহ্র সার্বভৌম ক্ষমতা বর্ণনা করছে।
আবার এখানে “পৃথিবী” শব্দের ভুলব্যাখ্যা হয়েছে, কারণ “পৃথিবী” (হিব্রু תּבל তেবেল এবং ארץ ‘এরেত্স ) দিয়ে সাধারণত আমাদের পুরো গ্রহ বোঝানো হয় না বরং “দেশ”, “মহাদেশ” বা “জমিন” বা “এলাকা” বোঝানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরো “জগত”-এর ধারণাটি এই শব্দটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না (যেমন পয়দায়েশ ৩৮:৯)। এই আয়াতগুলোতে আগেকার ভাষায় ‘পৃথিবীর স্থলভাগ’ বোঝানো হচ্ছে।
আইয়ুব ৯:৬ এবং জবুর ৭৫:৩ আয়াতে “থাম” এর মূল হিব্রু শব্দ עמוד ‘আম্মুদ, যার আরেকটি অর্থ “ভিত্তি” বা “মঞ্চ”। অর্থাৎ, বর্তমান পরিভাষায় এই আয়াত অনুবাদ করলে বলা হচ্ছে যে “মহাদেশীয় প্লেটগুলোর নিচে ভূগর্ভস্থ স্তর রয়েছে”। আল্লাহ্তা’লা প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা, উপমা ও বাক্যালংকার ব্যবহার করেছেন। তিনি যদি সেকালের মানুষদেরকে বলতেন, “…তখন আমি মহাদেশীয় প্লেটগুলোর ভূগর্ভস্থ স্তরগুলো টিকিয়ে রাখি,” কেউ বুঝত না। একই ভাবে কোরআন শরীফেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার হয় না বরং প্রাচীন চলতি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। মূল কথায়, এই আয়াতের উদ্দেশ্য হল মানুষের ভাষায় আল্লাহ্তা’লার সার্বভৌমত্ব বোঝানো, প্রকৃতির তথ্য বোঝানো নয়।
১ শামুয়েল ২:৮ আয়াতে হান্নার মোনাজাতের মধ্যে “থাম”-এর মূল হিব্রু শব্দ হচ্ছে “মাৎসুক”, যা কিতাবুল মোকাদ্দসে মাত্র ২বার ব্যবহার হয়েছে এবং যার অন্য অর্থ “অবস্থান” (১ শামুয়েল ১৪:৫)। তার অর্থ “ভিত্তি”ও হতে পারে। আবার মনে রাখা উচিত এটা আল্লাহ্র কিতাবে সংরক্ষিত একজন সীমিত জ্ঞানের মানুষের মোনাজাত, এটা আল্লাহ্র ঘোষণা হয়।
কোরআনেও কিছু আয়াত আছে যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে সমতল পৃথিবীর কথা বলে—
“এবং আকাশের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, তা কিভাবে উচ্চ করা হয়েছে?
…