আল্লাহ্ কথা নাকি মানুষের কথা?
“কোরআন শরীফ পুরোপুরি আল্লাহ্র কথা, কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসে মিশ্রিত আছে আল্লাহ্র কথা, নবীদের নিজেদের কথা, এবং ঐতিহাসিকদের কথা”
আল্লাহ্র কালাম (كلمةﷲ) সম্বন্ধে একটি ভুল ধারণার কারণেই এই অভিযোগ তুলা হয়। অনেকে মনে করে যে একবচন উত্তম পুরুষ বাক্য ছাড়া কোন কিছু আল্লাহ্ কালাম হতে পারে না, শুধুমাত্র আল্লাহ্র কণ্ঠের উক্তি হতে পারে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র মাপকাঠি ব্যবহার করলে শুধু ইঞ্জিল নয় বরং কোরআন শরীফও অযোগ্য হয়ে পড়ে, কারণ এই ভুল মাপকাঠি অনুযায়ী কোরআনের মধ্যে আল্লাহ্র বাণী, মানুষের বাণী এমনকি ফেরেশতার বাণীও রয়েছে। কোরআন শরীফের অধিকাংশ আয়াত মানুষদের কাছে আল্লাহ্র কথা। কিন্তু সূরা ফাতিহা হচ্ছে বিপরীত; আল্লাহ্র কাছে মানুষদের কথা। আবার সূরা মরিয়মের মধ্যে বাহক ফেরেশতা জিবরাইলেরও একটি উক্তি আছে – “আমি আপনার পালনকর্তার আদেশ ব্যতীত অবতরণ করি না”।
তাই ‘আল্লাহ্র কালামের’ এই ভুল সংজ্ঞা চলবে না, যে আল্লাহ্র বাণী শুধু একবচন উত্তম পুরুষ উক্তি হতে পারে। ইঞ্জিল শরীফে বলা হয়েছে:
“এই কথা মনে রেখো যে, কিতাবের মধ্যেকার কোন কথা নবীদের মনগড়া নয়, কারণ নবীরা তাঁদের ইচ্ছামত কোন কথা বলেন নি; পাক-রূহের দ্বারা পরিচালিত হয়েই তাঁরা আল্লাহ্র দেওয়া কথা বলেছেন। (ইঞ্জিল শরীফ, ১ পিতর ১:২১)
যেহেতু আল্লাহ্ অনেক সময় ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তার ইচ্ছা বিশেষভাবে প্রকাশ করেন, সেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সঠিকভাবে লিখে রাখার জন্য তিনি বিশেষ কিছু কিছু মানুষকে লিখতে পরিচালনা করেছেন, যেমন তৌরাত শরীফের ক্ষেত্রে তিনি হযরত মূসাকে লিখতে পরিচালনা করেছেন।
আল্লাহ্র কালামের একটি সুন্দর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার পর্যাপ্ততা এবং পরিপূর্ণতা – আল্লাহ্র প্রতি ভয়পূর্ণ জীবন কাটাতে যা যা জানা দরকার সবকিছু আল্লাহ্র কালামের মধ্যে পাওয়া যায়, অন্য কোথাও যেতে হয় না। হেদায়েত, দিক-নির্দেশনা, শরিয়ত এবং ইতিহাস, যথেষ্ঠ পরিমানে আল্লাহ্র কালামে রয়েছে, মানব জাতির জন্য আল্লাহ্র পরিপূর্ণ উপদেশ। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে সেগুলো অপর্যাপ্ত, যার কারণে মূল ধর্মগ্রন্থ বাদ দিয়ে অন্য ইতিহাস বইয়ের মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হয়।
ইঞ্জিল শরীফের মধ্যে পাক-রূহ্-শাশ্বত ‘ঐতিহাসিকদের কথা’ থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে ঈসা মসীহ্র অনন্য ভূমিকা। আগের যুগে আল্লাহ্ বিভিন্ন নবীদের কাছে বিশেষ বাণী দিতেন, কিন্তু ঈসা মসীহ্ হচ্ছে আল্লাহ্র জীবিত কালাম, তার জীবনই ছিল মানুষের কাছে আল্লাহ্র শাশ্বত বাণী। এইজন্য ইঞ্জিল শরীফের ভূমিকা একটু আলাদা, সেটা হচ্ছে প্রধানত আল্লাহ্র এই জীবিত কালামের কথা এবং কাজের একটি পাক-রূহ-শাশ্বত লিখিত সাক্ষ্য।
…
কিতাবুল মোকাদ্দস কি মানুষের গল্পের মত?
কিতাবুল মোকাদ্দস সহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পড়তে মানুষের গল্পের মত হয়,
কিন্তু কোরআন শরীফ সেরকম না”
আসলে অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ পড়তে কাহিনীর মত নয় বরং এলোমেলো মন্ত্রের মত।
আল্লাহ্র কালামের মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্র ইচ্ছা মানব জাতির কাছে সুন্দরভাবে, স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা। এইজন্য তিনি যেহেতু সবকিছুতে শ্রেষ্ঠ, তার কালাম এলোমেলো উক্তি বা অসংলগ্ন মন্ত্রতন্ত্রের মত হবে না, বরং ভূমিকা ও উপসংহার সহ সুন্দর ও ধারাবাহিক একটি পরিপূর্ণ লেখা – যেভাবে সকল যুক্তিসঙ্গত যোগাযোগ হয়। কিতাবুল মোকাদ্দসে আমরা এমন লেখা পাই। চিন্তা করেন – কোন স্কুল টেক্সটবুক বা প্রবন্ধ যদি প্রতিটি তিন লাইন পরপর হঠাৎ করে আলোচনার বিষয় পরিবর্তন হত, তাহলে সেটা কোন সুশিক্ষিত লোক ব্যবহার করত না।
আল্লাহ্ অবশ্য মানুষের ভাষার চেয়ে মহান, কিন্তু যখন মানবজাতির কাছে তিনি তার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন মানুষদের ভাষায়, তখন তিনি স্পষ্ট যোগাযোগে শ্রেষ্ঠ। তার কালাম যদি অস্পষ্ট এবং অসংলগ্ন হত, তাহলে তার অস্পষ্ট দূর্বল কালাম সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষ আরো স্পষ্ট বিকল্প ধর্মীয় বই লিখতে হত (নাউজুবিল্লাহ)। না, তার অসীম জ্ঞানে মাবুদ আল্লাহ্ তার কালাম নিখঁত এবং পরিপূর্ণ করেছেন। তার মধ্যে আছে ইতিহাসে আল্লাহ্র বিভিন্ন কাজের স্পষ্ট বিবরণ, এবং ধর্মসংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ের যথেষ্ট বিস্তারিত আলোচনা আল্লাহ্র কালামে পাওয়া যায়। হেদায়েতের জন্য অন্য কোথাও যাওয়া দরকার নেই।
আসলে কিতাবুল মোকাদ্দসের একটি আশ্চর্য বিষয় হল যে ২০০০ বছর জুড়ে প্রায় ৪০ আলাদা ব্যক্তির কাছে প্রদত্ত বাণী হলেও, তার মধ্যেকার লেখার এত স্পষ্ট মিল আছে। তার শুরুতে আছে ভূমিকা (পয়দায়েশ ১-১১), মাঝখানে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয় আল্লাহ্র মহাপরিকল্পনা, এবং শেষ কিতাবে আছে ভবিষ্যতের সমাপ্ত। তার মধ্যে আল্লাহ্র ইচ্ছা ভালভাবে জানার জন্য যথেষ্ট বিবরণ আছে—কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাদ দেওয়া হয় নি বা অন্য কোন ব্যাখ্যা বা টেক্সটবুক বা মানুষের লেখার কাছে যেতে হয় না। শুধুমাত্র নিজ মাতৃভাষায় আল্লাহ্র কালাম থাকলে, বিশ্বের যেকোন লোকের কাছে থাকত আল্লাহ্র পূর্ণাঙ্গ ইচ্ছা জানার জন্য যথেষ্ট হেদায়েত।
মরিস বুকাইলি দাবি করেছেন যে ইঞ্জিল শরীফের গসপেলগুলো রূপকাহিনী Song of Roland এর মত, “যেটা একটা বাস্তব ঘটনা মিথ্যা ভাবে সাজায়”। বুকাইলির দাবি হল যে ইঞ্জিলের গল্পগুলো ঐতিহাসিক বর্ণনা হিসেবে লেখা হয়নি বরং সৃজনশীল উপন্যাস হিসেবে লেখা হয়েছে। ডাঃ মৌরিস বুকাইলি কোন সাহ্যিতের বিশেষজ্ঞ নয়, কিন্তু বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিশেষজ্ঞ C.S.…
“তৌরাত ও ইঞ্জিল কি বাতিল বা অচল হয়ে গেছে?”
“তৌরাত ও ইঞ্জিল এখন সর্বশেষ কিতাব কোরআন দ্বারা
বাতিল বা অচল হয়ে গেছে।”
কিছু কিছু লোক দাবি করেন যে, শেষ-বাণী কোরআন শরীফের আগমনেই তৌরাত-ইঞ্জিল এখন অচল ও বাতিল হয়ে গেছে । এই কাল্পনিক দাবির জন্য কিন্তু কোরআন বা হাদিসে বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই, বরং সেটা আসলে কোরআন-বিরুদ্ধ একটি মনগড়া ধারণা। এই দাবি সত্য হলে কোরআন শরীফ ইহুদী-খ্রীষ্টানদের বলত না—
قُلْ يَـأَهْلَ الْكِتَـبِ لَسْتُمْ عَلَى شَىْءٍ حَتَّى تُقِيمُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْكُمْ مِّن رَّبِّكُمْ
“তৌরাত, ইঞ্জিল ও যা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে …তা পালন কর।”
(মায়িদা ৬৮)
—বরং বলতে, “তৌরাত ও ইঞ্জিল বাদ দিয়ে শুধু কোরআন শরীফই পালন করুন।” আবার কোরআন শরীফে বলা হত না—
وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فِيهِ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“ইঞ্জিল-অনুসারীগণ তদানুযায়ী বিচার করুক।
(মায়িদা ৪৭)
—বরং বলা হত “ইঞ্জিল-অনুসারীগণ এখন ইঞ্জিল বাদ দিয়ে কোরআন পালন করুক।”
তাই এটা পরিষ্কার যে, কোরআন শরীফ কখনও দাবি করেননি যে সেটা আগের কিতাব বাতিল করতে আসল, বরং সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা সমর্থন করতে আসল (মায়িদা ৫:৪৮) স্পষ্ট আরবী ভাষাই (আশ-শো’আরা ২৬:১৯৫)।
এই দাবি সত্য হলে ঈসা মসীহ্ তৌরাত বাতিল করে ইঞ্জিল প্রতিষ্ঠিত করতেন, কিন্ত তিনি সুস্পষ্টভাবে বলতেন যে তিনি তৌরাত বাতিল করতে আসেননি (ইঞ্জিল, মথি ৫:১৮)
বাতিল (মান্সুখ)?
…
“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”
“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”
হযরত পৌল এবং অন্যান্য সাহাবীদের মধ্যে যে কোন বড় ধরণের বিবাদ বা দ্বন্দ্ব ছিল তার জন্য ইঞ্জিলে কোন প্রমাণও নেই, ইঞ্জিলের বাইরে কোন স্বীকৃত ঐতিহাসিক দলিলেও কোন প্রমাণ নেই। সমালোচকেরা প্রেরিত ১৫:৩৯ আয়াতে হযরত পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে তর্কটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই আয়াত আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি:
কিছু দিন পরে পৌল বার্নাবাসকে বললেন, “যে সব জায়গায় আমরা মাবুদের কালাম তবলিগ করেছি, চল, এখনই সেই সব জায়গায় ফিরে গিয়ে ঈমানদার ভাইদের সংগে দেখা করি এবং তারা কেমন ভাবে চলছে তা দেখি।” তখন বার্নাবাস ইউহোন্নাকে সংগে নিতে চাইলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক বলেও ডাকা হত। পৌল কিন্তু তাঁকে সংগে নেওয়া ভাল মনে করলেন না, কারণ মার্ক পাম্ফুলিয়াতে তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের সংগে আর কাজ করেন নি। তখন পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে এমন মতের অমিল হল যে, তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। বার্নাবাস মার্ককে নিয়ে জাহাজে করে সাইপ্রাস দ্বীপে গেলেন, আর পৌল সীলকে বেছে নিলেন। তখন এণ্টিয়কের ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে মাবুদের রহমতের হাতে তুলে দিলে পর তাঁরা রওনা হলেন। পৌল সিরিয়া ও কিলিকিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সমস্ত জামাতগুলোর ঈমান বাড়িয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তুললেন। (প্রেরিত ১৫:৩৬-৪১)
এই ঘটনার আগে হযরত পৌল এবং বার্নাবাস দুই ভাই হিসেবে দীর্ঘদিনের একটি তবলিগ করেছিল একসাথে। উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে বিবাদের বিষয় মার্ককে সফরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নিয়ে। এটা কোন রকম ধর্মবিশ্বাসের বিবাদ ছিল না।
তার পরিবর্তে মজবুত প্রমাণ আছে যে এরা বিশ্বাসের ব্যাপারে একমত ছিল। যখন ৪৯ খ্রীষ্টাব্দে হযরত পৌল জেরুজালেমের ঈসায়ী নেতাদে্র সামনে তার বিশ্বাস এবং কাজের কথা বলেছিলেন, তখন এই সাহাবীরা খুশি হয়ে তাকে সম্পুর্ণভাবে গ্রহণ করলেন। হযরত পৌলের চিঠিগুলোর মধ্যে যে বিশ্বাস এবং সুসংবাদের কথা আছে, সেটা সাহাবী পিতর, সাহাবী ইয়াকুব এবং সাহাবী ইউহোন্নার চিঠিগুলোর মধ্যেও আছে। তারা ঈসায়ী মূল ‘সুসংবাদ’ বিশ্বাস নিয়ে একমত, যেটা এইভাবে সংক্ষিপ্ত করা যায়:
শুধু শরিয়ত পালন করার মাধ্যমে মানুষ নাজাত অর্জন করতে পারে না, কারণ তারা শরিয়ত পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পালন করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে তিনি একটি নাজাত, কাফফারা এবং পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেন হযরত ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে, যিনি একমাত্র নিষ্পাপ ব্যক্তি, “মনোনীত নাজাতদাতা”। তিনি ক্রুশে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করলেন এবং পুনরুত্থিত হলেন। এই নাজাতের দান কোন সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায় না বরং তওবা করে ঈসা মসীহ্র উম্মত হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়।
উপরোক্ত ‘সুসংবাদ’ শিক্ষাটি ইঞ্জিল শরীফের প্রত্যেকটি ২৭ খণ্ডে বার বার পাওয়া যায়। পুরো এই একই সুসংবাদের বাণী হযরত ঈসা মসীহ্ নিজেই বার বার বলেছেন— মথি ২৬:২৮; ইউহোন্না ৩:১৫, মথি ২০:২৮; মার্ক ১০:৪৫; ইউহোন্না ১০:৯; ইউহোন্না ১৪:৬; ইউহোন্না ৬:৪৪,৪৭,৪৮,৫১; ইউহোন্না ১০:১১; ইউহোন্না ১০:২৮; ইউহোন্না ১১:২৫; ইউহোন্না ১৭:১-২; ইউহোন্না ১৭:৩; লূক ২৪:২৬-২৭; লূক ৪:৪৩; ইউহোন্না ৬:২৯; ইউহোন্না ৬:৩৩,৩৫; ইউহোন্না ৪:১৪; ইউহোন্না ৫:২১; মথি ১৮:২১-৩৫। এই একই সুসংবাদ প্রচার করেছেন হযরত ঈসার উম্মত পিতর (প্রেরিত ২:৩৮; প্রেরিত ৪:১২; ১ পিতর ১:১৮-১৯; ২ পিতর ১:১৬), উম্মত ইয়াকুব (ইয়াকুব ২:১০), এবং উম্মত ইউহোন্না (১ ইউহোন্না ২:১,২)।
হযরত পৌলের জীবনী পড়লে বোঝা যায় যে তার বাণী থেকে তিনি কোন রকম দুনিয়াবী লাভ পাননি, অর্থাৎ মসীহ্ প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করার জন্য তার কোন কারণ ছিল না। হযরত পৌল যেভাবে প্রচার করতেন সেটা তার স্বার্থের বিপরীত ছিল। মসীহ্র উপর ঈমান আনার আগে তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল ছিল, তিনি বিখ্যাত আলেম গমলীয়েলের শিষ্য ছিলেন এবং রোমীয় নাগরিক ছিলনে (ইহুদীদের মধ্যে খুব কম লোকের এই সুবিধা ছিল)। মসীহ্র বাণী গ্রহণ না করলে তার নিশ্চয় মান-সম্মান, ধন এবং খ্যাতি অনেক থাকত। তিনি যদি ইহুদীদের কথামত বলতেন যে মসীহ্ কোন নাজাতদাতা নয় বরং শুধু একজন শরিয়ত-সমর্থক তাহলে সবাই তাকে পছন্দ করতেন এবং তার মান-সম্মান বেড়ে যেত। হযরত পৌল নিজেই লিখেছিলেন, “আমি যদি এখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করি তবে তো আমি মসীহের গোলাম নই।” (গালাতীয় ১:১০)।
মসীহ্র উপর ঈমান আনার আগে, হযরত পৌল ঈসায়ী জামাতের কঠিন শত্রু ছিলেন, তিনি ঈসায়ীদের ধরে তাদেরকে জেলখানায় ফেলে দিতেন (প্রেরিত ৯)। এইভাবে দামেষ্ক যাওয়ার পথে তিনি হঠাৎ মসীহ্র দর্শন পেয়েছিলেন। দুনিয়াবী স্বার্থের দৃষ্টি থেকে, তখন থেকেই তার জীবন পতন হল। ঈমান আনার পর থেকে তার জীবন কষ্টে ভরা ছিল। তাকে অত্যাচার ও মারধর করা হত, চাবুক দিয়ে আঘাত করত, পাথর ছুড়ে মারত, এবং তার জীবনে বিপদ, হুমকি, খিদে ও পিপাসার অভাব ছিল না (২ করিন্থীয় ১১:২৩-২৯)। তিনি অনেক বছর জেল কেটেছেন এবং সফরে জাহাজের দুর্ঘটনা ও ডাকাতের বিপদ সহ্য করেছিলেন। এই সময়ে তিনি কষ্ট করে চামড়ার কাজ করে আয় করতেন যেন কারো কাছে টাকা চাইতে না হয়। শেষে রোম শহরে তিনি শহীদ হলেন। এমন জীবনের এমন ব্যক্তি যে নিজ স্বার্থে মসীহ্র বাণী বিকৃত করেছেন, তা বলা বোকামি এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাসযোগ্য।
…
“ইঞ্জিল শরীফের চারটি জীবনী খণ্ড কি সাহাবীরাই লিখেছিলেন?”
“ইঞ্জিল শরীফের চারটি জীবনী খণ্ড (মথি, মার্ক, লূক, ইউহোন্না)ঈসা মসীহ্র প্রথম সাহাবীরা লেখেন নি”
সর্বপ্রথম ঈসায়ী জামাত যারা হযরত মথি, মার্ক, লূক এবং ইউহোন্না চিনতেন, তারা একবাক্যে সাক্ষ্য দিতেন যে এরা ইঞ্জিলের জীবনীগুলো লিখতেন। মথি এবং ইউহোন্না হযরত ঈসার ঘনিষ্ঠ বারজন সাহাবীদের মধ্যে ছিলেন, এই বারজনের মধ্যে হযরত পিতরের কাছে হযরত মার্ক তার জীবনী লিখে রেখেছেন, এবং হযরত লূক প্রথম ঈসায়ী জামাতের সদস্যও ছিলেন। ঐতিহাসিক দলিলগুলো প্রমাণ করে যে প্রথম জামাতে তাদের এই লেখাগুলো নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না। শুধুমাত্র এই গত দু’এক শতাব্দীতে কিছু নাস্তিকেরা ইতিহাসটা পরিবর্তন করতে চেষ্টা করছে। এদের নতুন ব্যাখ্যার পিছনে বিভিন্ন কারণ ও উদ্দেশ্য আছে:
১.…
“ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায় হতে পারে না, কারণ ঈসা মসীহ্ হিব্রু ভাষায় বলত”
“ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায় হতে পারে না, কারণ ঈসা মসীহ্ হিব্রু ভাষায় বলত”
জাকির নায়েক দাবি করেছেন:
যদিও ঈসা মসীহ্ (আঃ) হিব্রু ভাষায় কথা বলত, তোমাদের মূল পাণ্ডুলিপি তো গ্রীক ভাষায়”
ঈসা মসীহ্ সম্ভবত হিব্রু ভাষা একটু বুঝতে পারলেন, কিন্তু তার মাতৃভাষা অবশ্য হিব্রু না বরং গালীল প্রদেশের আরামীয় ভাষা। গ্রীক ছিল তখনকার বিশ্বের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা, এবং তাই প্যালেস্টাইনেও তা প্রচলিত ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে একজন রাজমিস্ট্রি হয়ে ঈসা মসীহ্ গ্রীক ভাষাও বলতে পারতেন। কিছু কিছু সময়ে ঈসা মসীহ্ আরামীয় ভাষায় শিক্ষা দিতেন, অন্য সময়ে গ্রী ভাষায় (যেমন মার্ক ৭:২৬-৩০)। ইঞ্জিল শরীফ অবশ্যই প্রথমে গ্রীক ভাষায় লেখা হয়েছিল, আরামীয় নয়। সারা বিশ্বে ঈসা মসীহ্র বাণী পৌঁছানোর জন্য গ্রীক ভাষা সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল, কারণ সেটা তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা ছিল। যারা এই রকম দাবি করে তারা সম্ভবত মনে করেন যে শুধুমাত্র আরবী এবং হিব্রুর মত সেমিতীয় ভাষায় নাজিলকৃত কিতাব আসতে পারে। কিন্তু কোরআন শরীফ নিজেই বলে যে কোরআন শরীফ আরবিতে নাজিল হয়েছে মাত্র একটি কারণে, “যাতে তোমরা বুঝতে পার” (সূরা ইউসুফ ১২:২)।
অন্যান্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ:
…
মূল হিব্রু তৌরাত কি হারিয়ে গেছে?”
“মূল হিব্রু তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাব (পুরাতন নিয়ম) হারিয়ে গেছে, তাই বর্তমান পুরাতন নিয়ম গ্রীক ভাষার অনুবাদ থেকে অনুবাদ হয়েছে”
জাকির নায়েক এই অবিশ্বাস্য দাবি করেছে:
“ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল হিব্রু আর নাই। আপনারা কি জানেন? ওল্ড টেস্টামেন্টের যে হিব্রু অনুবাদ আছে, সেটা গ্রীক ভাষা থেকে। তাই এমনকি মূল ওল্ড টেস্টামেন্ট, যেটা হিব্রুতে, সেটাও হিব্রুতে নাই।”
নায়েকের এই দাবি যে হিব্রু ওল্ড টেস্টামেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা পুরোপুরি ভুল। ওল্ড টেস্টামেন্টের জন্য শত শত প্রাচীন হিব্রু পাণ্ডুলিপি আছে, এমনকি ঈসা মসীহ্র আগে থেকে, যেগুলোর নাম Dead Sea Scrolls বা Qumran scrolls। এগুলো হচ্ছে ওল্ড টেস্টামেন্টের সবচেয়ে পুরানো পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপিগুলোর আবিষ্কারের আগে, সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ছিল হিব্রু ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রীক অনুবাদ যাকে বলা হয় Septuagint.…
“বিভিন্ন খ্রীষ্টান দলের কি আলাদা বাইবেল আছে?”
“বিভিন্ন খ্রীষ্টান দলের আলাদা বাইবেল আছে”
খ্রীষ্টধর্মের সকল শাখা—ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্স, লুথেরান, ইত্যাদি, তাদের প্রত্যেকে হুবহু একই তৌরাত (তোরাহ্), জবুর (গীতসংহিতা), এবং ইঞ্জিল (নতুন নিয়ম) আছে। কোরআনে উল্লেখিত এই তিনটি খণ্ডগুলো তুলনা করলে কোন পার্থক্য নেই। এমনকি, ইহুদী ধর্মাবলম্বিদের তৌরাত এবং জবুর শরীফ হুবহু একই, যদিও কিতাবের ক্রম একটু আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে।
“আপক্রিফা’ নামক কিছু খণ্ড নবীদের কিতাবের সঙ্গে দেওয়া উচিত কিনা এই নিয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক/অর্থোডক্স খ্রীষ্টানদের মধ্যে মতের অমিল রয়েছে। এগুলো প্রোটেস্টান্টেরা অস্বীকার করে, কারণ সেগুলো নবীদের আমলে লেখা হয় নি, কিন্তু ক্যাথলিকেরা সেগুলোকে কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে রাখে এবং সেগুলো ‘গৌণ’ বা ‘উপকারি’ বলেন। ইসলামের মধ্যে এমন রকমের একটি বিতর্ক আছে – শিয়ারা বলে থাকেন যে কোরআনের বাড়তি দুটি সূরা আছে যেগুলো সুন্নিরা বাদ দিয়েছে। কিন্তু এই ধরণের বিতর্ক তো কিতাবের বিশুদ্ধতা পরিবর্তন করে না।
…
কোরআনের সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনকালে
কোন লিখিত কোরআন ছিল না
যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বর্ণনা করেছেনঃ “নবীজী (সা) ইন্তেকাল করলেন এবং তখনও কোরআন শরীফ এক জায়গায় একত্র করা হয় নি।” (আহ্মদ বিন আলী বিন মুহাম্মদ ‘আস্কালানী, ইবনে হাজর, ফাত-আল-বারি (কাইরো (১৯৩৯), ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯ )
আলী (রা) থেকে বর্ণিতঃ আবু বকরের উপর আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হউক, যিনি পাণ্ডুলিপিগুলো সংকলন করতে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, কারণ সর্বপ্রথম তিনিই কোরআন শরীফ দুই জিলদের মধ্যে সংকলন করেছিলেন।” (ইবনে আবি দাউদ, কিতাবুল মাসাহিফ, পৃষ্ঠা ৫)
তার মারা যাওয়ার সময়ে হযরত মুহাম্মদ (সা) তার সাহাবাদের জন্য কোন লিখিত কোর’আন রাখেননি। ইয়ামামা যুদ্ধের পরে কোরআন হারিয়ে যাওয়ার আশংকায় হযরত আবু বকর (রাঃ) কোরআনের প্রথম লিখিত সংকলন করেনঃ
যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) বর্ণনা করেছেনঃ যখন ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক লোক নিহত হলেন সেই সময় আবু বকর (রা) আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন উমর ইবনে খাত্তাব তাঁর নিকটে উপস্থিত ছিলেন। তখন আবু বকর (রা) বললেন, উমর আমার কাছে এসে বলেছেঃ শাহাদত প্রাপ্তদের মধ্যে ক্বারীদের সংখ্যা অনেক। আমি আশঙ্কা করছি (ভবিষ্যতে যুদ্ধবিগ্রহে) আরো হাফেজে কোরআন শাহাদত লাভ করবেন এবং এভাবে কোরআনের বহু অংশ হারিয়ে যাবে। অতএব, আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, ‘আপনি কোরআন সংকলনের নির্দেশ দিন।’ তদুত্তরে আমি উমরকে বললামঃ যে কাজ আল্লাহ্র রসূল (স) করেননি সেই কাজ কিভাবে করবে?
…
ইঞ্জিল সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
কোরআন এবং ইঞ্জিলের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল বাণী এবং বাণীবাহকের পার্থক্য। কোরআনের ক্ষেত্রে, কোরআন হল বাণী এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) শুধু সেই আল্লাহ্র বাণীর বাহক। কিন্তু ইঞ্জিলের ক্ষেত্রে বিপরীত; হযরত ঈসা মসীহ্ ছিলেন জীবিত আল্লাহ্র বাণী, এবং ইঞ্জিল শরীফ হচ্ছে সেই জীবিত বাণীর লিখিত সাক্ষ্য। ঈসা মসীহ্ কোন লিখিত বাণী নিয়ে আসেননি, বরং তার জীবন ও শিক্ষার আল্লাহ্-শ্বাশ্বত সাক্ষ্য হিসেবে ইঞ্জিল শরীফ লেখা হয়েছে। কোরআন এবং ইঞ্জিল তুলনা করার আগে এই কথা মনে রাখা দরকার।<p>
ইঞ্জিল শরীফের মূল খণ্ডগুলো হযরত ঈসার সাহাবীরা লিখেছিলেন খ্রীষ্টাব্দ ৫১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত, ঈসা মসীহ্র বেহেশতে ফিরে যাওয়ার বিশ বছর পর থেকে। এই মূল সুখবর এবং চিঠিগুলো লেখার পরপরই সেগুলোর বিভিন্ন কপি এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন জামাতের কাছে ছড়িয়ে পড়ল। কোরআন শরীফের ক্ষেত্রে যেমন হযরত আবু বকরের এবং হযরত ওসমানের (রা) সর্বপ্রথম কপিগুলো হারিয়ে গেছে, তেমনই ইঞ্জিলের প্রথম কপিগুলো হারিয়ে গেছে। <p>
ইঞ্জিল শরীফের সবচেয়ে পুরানো পাণ্ডুলিপি হচ্ছে <span class=”english” lang=”en”>p52</span> নামক ইউহোন্না ১৮ অধ্যায়ের এক পৃষ্ঠার অংশ যেটা লেখা হয়েছে ১৩৫ খ্রীষ্টাব্দ, অর্থাৎ মূল লেখার মাত্র চল্লিশ বছর পর। ২০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে লূক, ইউহোন্না এবং পৌলের দশটি চিঠির জন্য পাণ্ডুলিপি আছে।<p>
ইঞ্জিল শরীফের সবচেয়ে পুরানো পূর্ণ কপি হচ্ছে ৩০০ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে ব্রিটিশ যাদুঘরে অবস্থিত <span class=”english” lang=”en”>Codex Sinaiticus</span>.…