দা ভিঞ্চি কোড ও আসল ইতিহাস
দুঃখের ব্যাপার হল, অনেকেই বুঝতে পারেনা যে, দা ভিঞ্চি কোড শুধুই একটি কাল্পনিক গল্প যা মানুষকে বিনোদন দিতে ও বই বিক্রি করতে লিখা হয়েছে। এটি ইতিহাস নয়। লেখক যাই দাবি করুক, এটি প্রচুর ঐতিহাসিক ভুল তথ্যে ভরা। এমনকি ঈসায়ী বিশ্বাসের তীব্র প্রতিপক্ষ পযর্ন্ত লিখতে বাধ্য হন:
“দা ভিঞ্চি কোড …অবশ্যই প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত বানানো, উদ্ভাবিত এবং নির্মিত কল্পসাহিত্য”। ১
যদি বইটি পড়ে থাকেন অথবা চলচ্চিত্রটি দেখা হয়ে থাকে তাহলে বইটির কোন অংশ বাস্তব আর কোন অংশ কাল্পনিক তা ভালোভাবে এখানে জানতে পারবেন
সূচিপত্র
ঈসা কি বিবাহিত ছিলেন?
কোন প্রমাণ নেই যে ঈসা বিবাহিত ছিলেন। সব ঐতিহাসিক দলিলপত্র ও পণ্ডিতগণ বিপরীত দিকে নির্দেশ করেন, যে তিনি বিবাহিত ছিলেন না। ইসলামও এতে একমত। ঈসা এবং মগদলিনী মরিয়ম এর মধ্যে একক সম্পর্কের (তবুও বিয়ে নয়) তথ্য একমাত্র পাওয়া যায় ইঞ্জিলের ২০০ বছর পর লিখা দুটি নস্টিক লিখা “গসপেল অফ মেরি” ও “গসপেল অফ ফিলিপ” থেকে। এমনকি এ দুটোতেও দাবি করা হয়না যে ঈসা বিবাহিত ছিলেন। এগুলোর ঐতিহাসিক পরম্পরা জানতে “ মিথ্যা গসপেলগুলো” প্রবন্ধ পড়ুন । বইয়ের একটি চরিত্র বলে যে, ঈসার বিবাহ “ঐতিহাসিক লিপি”, কিন্তু কোন পণ্ডিত তা সমর্থন করবেন না। যে ঐতিহাসিক লিপির কথা ব্রাউন বলেন তা হল বিংশ শতাব্দীর ষড়যন্ত্র বই, কিন্তু মোটেও প্রাথমিক ঈসাই লিপি নয়।২
Priory of Sion এর কি কোন অস্তিত্ব আছেঃ
ব্রাউন প্রচুর ধারণা নিয়েছেন পিয়েরে প্লান্টার্ডের লিখা Bibliotheque Nationale এর একটি দলিল Les Dossiers Secrets d’Henri Lobineau থেকে যা “Priory of Sion” সমর্থন করে। মজার ব্যাপার হল যে, প্লান্টার্ড নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই দলিল স্রেফ একটি ভাওতাবাজি ছিল। “Priory of Sion” ধোঁকাবাজিটি পরীক্ষা করা হয়েছে একটি CBS 60 Minutes প্রোগ্রামে ও এখানে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাতী ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক জোনাথান রিলি স্মিথ বলেন,
“আমি জানি দ্বাদশ শতাব্দীতে জেরুজালেমে কি হচ্ছিল। আমি ৪০ বছর এ নিয়ে কাজ করেছি আর এ লোকগুলো যা বলে–তা কখনও ঘটেনি” ( লিংক)
দা ভিঞ্চি কোড যে গসপেল উৎসগুলোর কথা বলে সেগুলো আসলে কি?
নাগ হাম্মাদি দলিলগুলো ইঞ্জিল লিখার অনেক অনেক পরে নস্টিক লিখাগুলোর একটি সংগ্রহ যা ১৯৪৫ এর দিকে মিসরে পাওয়া যায়। ডা ভিঞ্চি কোড দাবি করে যে:
“এগুলো একদম প্রাথমিক ঈসায়ী লিপি, সমস্যা হল যে এসব কিতাবুল মোকাদ্দাসের(বাইবেলের) সুসমাচারগুলোর সাথে মিলে না”” (পৃষ্ঠা ২৪৫-২৪৬).
এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ এগুলো মোটেও প্রাথমিক ঈসায়ী লিপি নয়। ইঞ্জিল লিখা হয় ৪০ থেকে ৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অপরদিকে নাগ হাম্মাদি দলিলগুলো লিখা হয়েছিল ৩০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এমনকি সবচাইতে প্রথম নাগ হাম্মাদি দলিল(“গসপেল অফ থমাস“) পযর্ন্ত ১৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে লিখা যা সর্বশেষ সাহাবীরও দুই পুরুষ পর। এর মধ্যে আছে গসপেল অফ থমাস, গসপেল অফ মেরী এবং গসপেল অফ ফিলীপ।
সেগুলোতে কি নারীদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করা হয়
‘গসপেল অফ মেরী” তে আসলে নারীদের সম্পর্কে প্রচণ্ড অপমানজনক দৄষ্টান্ত দেখা যায়। মেরী বলেনঃ
“চলুন আমরা মসীহের মহত্ত্বের প্রশংসা করি!তিনি আমাদেরকে সবাইকে প্রস্তুত করেছেন পুরষে পরিণত করার মধ্য দিয়ে”
আরেকটি নস্টিক গসপেলে আছে যে ঈসা বলেছেন,
“সেসব নারী যারা নিজেদেরকে পুরুষ বানাবে তারা বেহেস্তী রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে”
অন্য কথায় যদি নারীদের একমাত্র আশা থাকে পুরুষে পরিণত হওয়া …এটাকে মোটেও তাদেরকে উচ্চাসনে বসানো হয়না।
ঈসায়ীরা কেন সেগুলোকে গ্রহণ করেনি?
প্রধান কারন হচ্ছে অবশ্যই যে সেগুলো প্রথম সাহাবি সম্প্রদায় লিখেননি। দ্বিতীয়ত, এখানে যে দর্শন পাওয়া যায়, তা হচ্ছে নস্টিসিসম, যার সম্পর্ক ঈসার সাথে নয় বরং গ্রীক ও পৌত্তলিক দার্শনিকতার সাথে। নস্টিসিসম মতে, আল্লাহ দুইজন আর যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি মন্দ।
এ সম্পর্কে আর জানতে “ মিথ্যা গসপেলগুলো” প্রবন্ধ পড়ুন।
ডা ভিঞ্চি কোড বইয়ে আছে:
“টিবিং একটা বিশাল বয় পেল আর সেটি টেবিলে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসলো। পোস্টারের আকারের চামড়া দিয়ে ঢাকা সংস্করণটি দেখাচ্ছিল একটি বিশাল এটলাসের মত। কাভারে লিখা: “নস্টিক গসপেলস”। টিবিং বলল, ”আমি আগে যেসবের কথা বলেছিলাম এগুলোই সেই নাগ হাম্মাদি ও ডেড সী স্ক্রলস। এগুলো একদম প্রাথমিক ঈসায়ী লিপি, সমস্যা হল যে এসব কিতাবুল মোকাদ্দাসের(বাইবেলের) সুসমাচারগুলোর সাথে মিলে না।” (পৃষ্ঠা ২৪৫-২৪৬)
ডেড সী স্ক্রলগুলোতে কোনই নস্টিক গসপেল বা ঈসায়ী দলিল নেই, শুধুই ইহুদি। কোথাও ঈসার কোন কথা নেই।
“হলি গ্রেইল” এর ধারণা কোত্থেকে এসেছে?
১১৭০ এর আগে হলি গ্রেইল (পবিত্র পাত্র) ধারনার কোন অস্তিত্ব ছিল না। এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, এটি একটি কাল্পনিক ধর্মীয় গুজব যেটি মানুষের কিচ্ছা-কাহিনীতে জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে। সম্ভবত ১১৭০ এ এক ফরাসী “পার্সিভাল” নামে একটি সৃষ্টিধর্মী কবিতা লিখেন যেটি সম্ভবত এই গ্রেইল (পাত্র) ধারণাটির জন্ম দেয়, যেটি পরবর্তীতে জনপ্রিয় লিখাগুলোতে দেখা যেতে থাকে।
সত্যি কি দা ভিঞ্চির “লাস্ট সাপার” চিত্রশিল্পটি
কোন কোড বার্তা বহন করে?
না। এই বইতে যে ধারণা দেয়া হয়েছে যে এই ছবিতে যেহযরত ইউহোন্না(যোহন) সে আসলে মগদলিনী মরিয়ম…এটি কোন শিল্প ইতিহাসবিদ সমর্থন করেননা। আসলে ঐ সময়ে সাহাবীদের ছবিতে মেয়েলী ভাব খুবই স্বাভাবিক ছিল। আর্ট ইন্সটিটিউট অফ শিকাগোর ইউরোপীয় ডেকোরেটিভ আর্ট ও স্কাল্পটার বলেনঃ
”এই খুন রহস্যের সাথে আসল লিওনার্দোর সম্পর্ক কী?সংক্ষিপ্ত উত্তর বেশী না, আর ঐতিহাসিক লিওনার্দোর ব্যাপারে লেখকের ধারণা কম।” ( পুরো নিউ ইয়োর্ক টাইমস প্রবন্ধটি পড়ুন এখানে )
নাইসিয়ার কাউন্সিলটি কিসের জন্য ছিল?
দা ভিঞ্চি কোড মতে:
“নাইসিয়া কাউন্সিলে ঈসাকে ইবনুল্লাহ হিসেবে অফিসিয়ালভাবে প্রস্তাব দেয়া হয় এবং এর ওপর ভোটাভুটি করা হয়…আর তা খুবই কাছাকাছি ব্যবধান হয়।” (পৃষ্ঠা ২৩৩)
ওটা হাড্ডাহাড্ডি ভোট লড়াইয়ের ব্যাপার ছিল না..। চাক্ষুষ সাক্ষীর মাধ্যমে, ৩০০র উপরে জামাত নেতার মধ্যে মাত্র দুইজন নাইসিয়ান দলিলে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।
দ্বিতীয়ত, নাইসিয়ার সভায় যার বিরোধিতা করা হয় তা হল আরিয়াসের জঘন্য ভ্রান্ত শিক্ষা। আরিয়াসের শিক্ষা ছিল আল্লাহ ঈসাকে সৃষ্টির আগে এক সময় জন্ম দিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ) আর ঈসা শুধুই একজন সৃষ্ট প্রাণী। তবে উভয় পক্ষই একই ইঞ্জিলের সুসমাচার গ্রহণ করে, কিন্তু দা ভিঞ্চি কোড যা বলে তা বানোয়াট কারণ কেউই নস্টিক গসপেল গ্রহণ করেনি। এ সম্পর্কে আর জানতে “ মিথ্যা গসপেলগুলো” প্রবন্ধ পড়ুন।
কিতাবুল মোকাদ্দাসে কি যাবে তা কি কন্সটান্টিন নির্ধারণ করেন?
দা ভিঞ্চি কোডে আছে:
“কিতাবুল মোকাদ্দাসে যা আছে তা পৌত্তলিক সম্রাট কন্সটান্টিন নির্ধারণ করেন” (পৃষ্ঠা ২৩১)
সম্পূর্ণ বানোয়াট। এই লিখাগুলো পড়ুন:
কন্সটান্টিন এবং ৩২৫ সালের ক্যানন
রাজনৈতিক কারণে কি চার্চ বাইবেলটি পরিবর্তন করেছিল?
* * *
ঈসা কি রাজাদের পরাজিত করেছিলেন?!!
দা ভিঞ্চি কোড : “পূর্বে ভবিষ্যতবাণীকৃত মসীহ হিসেবে, ঈসা রাজাদের পরাজিত করেন, লক্ষ লক্ষ লোককে অনুপ্রেরণা দেন এবং নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠিত করেন”
আসল ইতিহাস : ঈসা কখনও কোন বাদশাহকে পরাজিত করেননি, এটা জানতে ইতিহাসবিদ হওয়া লাগে না।
মেরোভিঞ্জিয়রা প্যারিস শহরটি স্থাপন করে?
দা ভিঞ্চি কোড : “মেরোভিঞ্জিয় একটি শব্দ ছিল যা ফ্রান্সের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই শিখতে হত। মেরোভিঞ্জিয়রা প্যারিস শহরটি স্থাপন করে।” (মূল ইংরেজি বইয়ের পৃ ২৫৭)
আসল ইতিহাস :প্যারিস নগরীটি ২০০ বছর পুরানো। মেরোভিঞ্জিয় শাসক প্রথম ক্লভিস ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে প্যারিসে তার আসন গাড়েন।
লিউনার্দো দা ভিঞ্চি কি ভ্যাটিকানের জন্য
শত শত কমিশন করেছিলেন?
দা ভিঞ্চি কোড : লিউনার্দো দাভিঞ্চি যে শত শত ভ্যাটিকানের দেওয়া প্রকল্পগুলো গ্রহণ করে যে ঈসায়ী চিত্রকর্মগুলো আঁকেন তাতে তার নিজের বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল না, বরং বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য একটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কাজ হাতে নেওয়া। (পৃ ৪৫)
আসল ইতিহাস : ভিঞ্চির কোন বড় আকারের সম্পত্তি ছিল না আর ভ্যাটিকান থেকে মাত্র একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প পেয়েছিলেন।
জিহোভা নামটি পৌরাণিক পুং–স্ত্রী নাম থেকে আসে?
দা ভিঞ্চি কোড : “ইহুদি চতুরাক্ষর ( ইয়াহওয়েহ) যা আল্লাহর নাম তা এসেছে জিহোভা নামটি থেকে আর পুংলিঙ্গ “ জাহ” ও হাওয়ার আদি হিব্রু নাম “হাভাহ” এর সমন্বয়ের মাধ্যমে।” (পৃ ৩০৯)
আসল ইতিহাস: ইয়াহওয়েহ মোটেও জিহোভা থেকে আসেনি, কিন্তু আদনাই(প্রভু) থেকে হিব্রু ব্যঞ্জনবর্ণ “আমি” তে হরকত যুক্ত করে।
লক্ষ লক্ষকে ডাইনী হিসেবে পোড়ান হয়?
দা ভিঞ্চি কোড : জামাত ৫০ লক্ষকে ডাইনী হিসেবে পুড়িয়ে মারে।
আসল ইতিহাস : ইতিহাসে ডাইনী হিসেবে পুড়িয়ে মারার সংখ্যা গুনে সবচাইতে বড় হিসাব যা পাওয়া গেছে তা ১০ লক্ষের কাছাকাছিও নয়। এর মধ্যে ২০% ছিল পুরুষ।
অলিম্পিক কার জন্য অনুষ্ঠিত হত?
দা ভিঞ্চি কোড : আফ্রডাইট
আসল ইতিহাস: জিউস
ঈসায়ী বিশ্বাসকে কার আমলে রোমীয় রাষ্ট্রধর্ম বানানো হয়েছিল?
দা ভিঞ্চি কোড : কন্সটান্টিন
আসল ইতিহাস: সম্রাট কন্সটান্টিনের ৫০ বছর পর থেওসোডিয়াসের তত্ত্বাবধানে।
Nights Templar সংগঠন ও গোলাকৃতি চার্চ ঘর
দা ভিঞ্চি কোড : টেম্পলাররা গোলাকার জামাতঘর স্থাপন করেন আর গোলাকৃতিকে জামাত অপমানজনক হিসাবে গ্রহণ করত।
আসল ইতিহাস : টেমপ্লাররা যেসব জামাতঘর তার সবই যে গোলাকার ছিল তা নয়(উদাহরণঃদ্য লিটল ম্যাপালস্টেড) আর যেগুলো ছিল তা পবিত্র সেপাল্কার জামাতের জন্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে।
Nights Templar সংগঠন গোথিয় নির্মানশিল্পে উদ্যোগী হন
দা ভিঞ্চি কোড : টেমপ্লাররা গোথিয় ক্যাথেড্রাল গুলো নির্মাণে উদ্যোগী হয়।
আসল ইতিহাস : নাইট টেম্পলাররা ছিল মধ্যযুগের সৈন্যদল মাত্র। নির্মাণশিল্প, রাজমিস্ত্রিদের সংঘ অথবা গোথীয় ক্যাথেড্রালের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না।
- Richard Dawkins, The God Delusion.
- Amy Welborn, The Da Vinci Code: The facts behind the fiction.
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:
Leave a Reply