বিজ্ঞান, কিতাব ও বিশ্বাস
আল্লাহ্র কালাম ও বিজ্ঞানের যথার্থ সম্পর্ক
সূচিপত্র:
প্রথম খণ্ড : বুকাইলিবাদের পরিচয়
বুকাইলিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর ধারণা
বেদ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়”
কিছু “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’-এর বিশ্লেষণ
-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় #১ : চাঁদের প্রতিফলিত আলো
-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় # ২ : মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়সমূহ
-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় # ৩ : পিপড়াদের মধ্যে যোগাযোগ
দ্বিতীয় খণ্ড : কিতাব ও বিজ্ঞানের সমন্বয়
সূর্যের পূর্বে উদ্ভিদজগত সৃষ্টি?
বিশ্বতত্ত্ব : পৃথিবী সমতল না গোলাকার?
– পৃথিবী কী চ্যাপটা না গোলাকার?
– সূর্য, চাদ, তারা, উল্কাপিন্ড ও আসমান।
তৃতীয় খণ্ড : বিজ্ঞানের ইতিহাস
ইসলামের স্বর্ণযুগের সমাপ্তির কারণ কী?
প্র থ ম খ ণ্ড
“বুকাইলিবাদ” সম্পর্কে
বুকাইলিবাদ (Bucailleism) হল কোরআন শরীফের মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের জন্য অনুসন্ধান – আধুনিক যুগের নতুন আবিষ্কার যেগুলো দুর্বোধ্যভাবে কোরআন শরীফে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে। এখানে জাকির নায়েকের বুকাইলিবাদের একটি সাধারন উদাহরণ দেওয়া হলো—
চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো – আগের সভ্যতাগুলোর ধারণা ছিল, চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। কিন্তু বিজ্ঞান বর্তমানে আমাদেরকে বলে যে, চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো। এ সত্যটি কোরআন আমাদেরকে আজ থেকে ১৪শ বছর আগে বলেছে নিম্ন আয়াতে:
“কত মহান তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করিয়াছেন রাশিচক্র এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।”
(সূরা ফুরকান ২৫:৬১)আরবীতে সূর্যকে ‘শাম্স’ বলে। ‘সিরাজ’ শব্দ দ্বারাও সূর্য বুঝানো হয়েছে… চাঁদের আরবী প্রতিশব্দ হল ‘ক্বামার’ এবং কোরআনে চাঁদকে ‘মুনীর’ বলেছে। এর অর্থ হল ‘নূর’- আলো দানকারী, অর্থাৎ প্রতিফলিত আলো দেয়… এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআন সূর্য ও চাঁদের আলোর মধ্যকার পার্থক্যকে স্বীকার করে। ১
ঠিক তেমনভাবে দাবি করা হয়েছে যে কোরআনে কৃষ্ণ বিবর (black holes), ভ্রূণতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, এবং জ্যোতির্বিদ্যার আশ্চর্য বর্ণনা পাওয়া যায়।
<
বুকাইলিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর ধারণা
কোরআন শরীফে এইভাবে দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক বিস্ময়গুলোকে খুঁজে বেড়ানো ইসলামের ইতিহাসে খুব অল্পদিনের একটি ধারা। রক্ষণশীলদের মধ্যে বুকাইলিবাদ খুব জনপ্রিয়তা পেলেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তেমন সমর্থন পায় নি। ভারতের সুপরিচিত ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ ও বেহেশ্তী জেওর -এর রচয়িতা, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) চারটি কারণে বুকাইলিবাদ পন্থার বিরোধিতা করেন।২ একইভাবে, পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান মুসলিম বিজ্ঞানীরা বুকাইলিবাদ প্রচেষ্টা দেখে শুধু লজ্জিত হয়। লন্ডনের বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ জিয়াউদ্দিন সরকার , তার বই Explorations in Islamic Science এই ‘বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’ যুক্তিকে বলে “apologia of the worst type” [আত্মপক্ষসমর্থনের সবচেয়ে খারাপ প্রকার]। বিশিষ্ট বুকাইলিবাদ সমালোচক Penn State বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ইতিহাসবিদ নোমানুল হক অনুযায়ী বুলাইলিবাদের বৃদ্ধির মূল কারণ হলো ঔপনিবেশিকতাবাদে লজ্জিত এবং ইসলামি বিজ্ঞানের হারানো গৌরব আবার অধিকার করতে ইচ্ছুক মসলমানদের মধ্যে “একটি গভীর, গভীর হীনমন্যতাবোধ।”৩ আরেকজন মুসলিম বুকাইলিবাদের সমালোচক হল মুজাফফর ইকবাল , যিনি কানাডার অ্যালবার্টায় অবস্থিত Center for Islam and Science সংস্থার প্রেসিডেন্ট।
বুকাইলিবাদের বিরুদ্ধে একটি বই লিখেছেন (وهم الإعجاز العلمى অর্থাৎ ‘কোরআনে কি সত্যি বিজ্ঞানের বিস্ময় রয়েছে?”) মিসরের মুসলমান বুদ্ধিজীবী ডা. খালেদ মন্তাসের , এবং মিসরের বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গ্র্যান্ড ইমাম শেখ মাহ্মুদ শালতুত এই ‘কোরআন-বিজ্ঞান’ এর বিরোধীতা করতেন।
পাকিস্তানের বিশিষ্ট পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী পারভেজ হুডভয় লিখেছেন—
the problem with such claims to ownership is that they lack an explanation for why quantum mechanics, molecular genetics, etc., had to await discovery elsewhere. Nor is any kind of testable prediction ever made. No reason is offered as to why antibiotics, aspirin, steam engines, electricity, aircraft, or computers were not first invented by Muslims. But even to ask such questions is considered offensive.৪
[এই রকম মালিকানার দাবীর সমস্যা হল, কোয়ান্টাম মেক্যানিক্স, মলিকিউলার জেনেটিক্স, ইত্যাদি কেন অন্য জায়গায় আবিস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারে না। । আবার বিভিন্ন গবেষণা বা পরীক্ষা করে প্রমাণ করার মতো কোন বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী কোরআনে কখনো করাও হয়নি। কোরআনে যদি বৈজ্ঞানিক নানা ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই থাকে তাহলে কেনই বা সবার আগে মুসলমানরা এন্টিবায়োটিক, এসপিরিন, বাষ্প-ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, বিমান কম্পিউটার উদ্ভাবন করে নি। কিন্তু এই ধরণের প্রশ্ন উঠলেই কেবল সেটাকে আক্রমণাত্মক বলে মনে করা হয়।]
তুরস্কের মুসলিম দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী তানের এদিস লিখেছেন—
“Quran-science is pathetic, but this is realized by many Muslims as well. It does not characterize Islam any more than the Institute for Creation Research typifies Christianity. Yet, even with that important qualification, the ridiculous extreme I described above can illustrate the ambiguous relation between modern science and orthodox Islam. While most believers are content to ignore the issue and declare full scientific compatibility for the Quran, some intellectuals take a cognitive relativist path, or insist that science be structured by Islam so as to comply with an Islamic view of nature.
[“কোরআন-বিজ্ঞান (বুকাইলিবাদ) বিষয়টি হাস্যকর, কিন্তু অনেক মুসলমানেরা তা-ও জানেন। সেটা ইসলামকে বিশেষভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না যেমনই ক্রিয়েশন রিসার্চ ইন্সটিট্যুট খ্রিষ্টধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ শুদ্ধিকরণ দিয়েও, উপরোক্ত যে হাস্যকর চরমমাত্রা আমি বর্ণনা করেছি দেখায় আধুনিক বিজ্ঞান ও গোঁড়া ইসলামের দ্ব্যর্থক/অনিশ্চিত সম্পর্ক। যেখানে অধিকাংশ ঈমানদার আসল বিষয়টা অবহেলা করে কোরআনের জন্য পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সুসংগতি ঘোষণা দিতে তৃপ্ত, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী কগ্নিটিভ্ রেলাটিভিস্ট্ পথ অবলম্বন করে, অথবা বলে যে বিজ্ঞান ইসলাম অনুসারে নির্মিত হওয়া উচিত যেন ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায়।”] ৫
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী মুসলিম জনপ্রিয় বক্তা আবু আম্মার ইয়াসির ক্বারী তার বই An Introduction to the Sciences of the Quran তে লিখেছেন:
“In other words, there are not scientific allusions buried under every third verse in the Qur’aan, waiting to be unearthed by some over-zealous, highly-imaginative Muslim!”৬
[অন্য কথায়, কোরআনের প্রতি তিনটি আয়াত অন্তর অন্তর এমন কোন বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত লুকিয়ে নেই যা কোন অতি-কল্পনাপ্রবণ ও অতি-আগ্রহী মুসলমানের দ্বারা উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে।]
পুরো “ইসলামী বিজ্ঞান” বিষয়ে পাকিস্তানী নোবেলপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম লিখেছেন:
“There is only one universal science; its problems and modalities are international and there is no such thing as Islamic science just as there is no Hindu science, nor Jewish science, no Confucian Science, nor Christian Science.”৭
[কেবলমাত্র একটি সার্বজনীন বিজ্ঞান রয়েছে; বৈজ্ঞানিক সমস্যা এবং পন্থাগুলো সবই আন্তর্জাতিক ও সার্বজনীন। যেহেতু হিন্দু বিজ্ঞান, ইহুদী বিজ্ঞান, কনফুসিয়াস বিজ্ঞান ও খ্রীষ্টান বিজ্ঞান বলে কিছু নেই সেহেতু ইসলামিক বিজ্ঞান বলে কিছু নেই। ]
বুকাইলিবাদের সমস্যাগুলো
বুকাইলিবাদ অনুযায়ী, আল্লাহ্ কোনকিছু অতি পরিষ্কার বলতে ব্যর্থ, তর্কাতীত স্পষ্ট হতে অক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, যদি আল্লাহ সত্যই কোরআনে বোঝাতে চাইতেন যে পৃথিবী গোলাকার, তাহলে তিনি কেন একটা আয়াতে স্পষ্ট করে এইভাবে লেখেন না: “তুমি কী বিবেচনা করনি, আমি কীভাবে পৃথিবীকে সমতল নয় বরং গোলাকার বানিয়েছি, এবং সূর্যের চারপাশে ঘুর্ণায়মান করে পৃথিবীকে তৈরি করেছি?” অথবা আল্লাহ যদি টেলিভিশন নিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চাইতেন, তিনি কি সুস্পষ্ট করে বলতে পারতেন না যে: “মানব জাতি এক সময় তাদের ঘরে বাক্সের ভিতরে ছবি দেখবে।” অন্য প্রসঙ্গে তো আল্লাহ কিন্তু অতি পরিষ্কার করে কথা বলেছেন! যেমন আল-ইমরান ২ আয়াত:
“আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্ত্বার ধারক।”
এই আয়াতটি তো পানির মতো পরিষ্কার, কোন তর্কাতর্কির অবকাশ নেই। যদি আল্লাহ চাইতেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু জিনিস কোরআনে বর্ণনা করবেন তাহলে তিনি কাউকে সমালোচনার সুযোগ না দিয়ে পরিষ্কার ভাবেই তা পেশ করতেন।
দ্বিতীয়ত, মাওলানা থানভী সতর্ক করেন যে আমরা কিতাবের সত্যতা বিপদগ্রস্ত করি যদি আমরা তার আয়াতগুলো বর্তমান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করি, কারণ সেগুলো দশ বছর পর ভুল প্রমাণিত হতে পারে। উদাহরণসরূপ, জাকির নায়েক গর্ব করে বলেন যে কোরআনে মহা বিস্ফোরণ অর্থাৎ বিগ ব্যাংগের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে (যদিও এই তত্ত্ব সর্বপ্রথম একজন ক্যাথলিক ফাদার উত্থাপন করেন)। যেহেতু আজ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক সমাজ এই তত্ত্বের সত্যতা সম্পর্কে একমত নয়, তাহলে দশ বছর পর যদি সেটা ভুল বলে প্রমাণিত হয় তাহলে কোরআনে এই সুস্পষ্ট তত্ত্বের ব্যাপারে আমরা কী বলবো? তাহলে বুকাইলিবাদ কী ধরে নিবে যে কোরআন ভুল?
বুকাইলিবাদের ইতিহাস
এই পুরো নিরর্থক ধারণা চালু করেছেন একজন অ-মুসলিম ফরাসি ডাক্তার, মরিস বুকাইলি। সৌদি বাদশাহ্ ফয়সালের পারিবারিক ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত করার পর, বুকাইলি ‘বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান’ বইটা প্রকাশ করে দাবি করেন যে কোরআন বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানসম্মত কিন্তু বাইবেল তা নয়। মরিস বুকাইলির পরে, ইয়েমেনের শেখ আব্দুল মাজিদ জিদানী নামে একজন চৌকস রাজনীতিবাদ সৌদি আরবে অবস্থিত Commission on Scientific Signs in the Qur’an and Sunnah প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশ্বব্যাপী বুকাইলিবাদ প্রচারের প্রধান উদ্যোক্তা হয়ে উঠে। ইদানিংকালে জিদানীর ধারণা ও তত্ত্ব ধর্মীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভারতে জাকির নায়েক এবং মিসরে যাঘলৌল এল-নাগার। ফ্রি প্রথম শ্রেণীর বিমান টিকিট, ৫-স্টার হোটেল বুকিং, ১,০০০ ডলার পারিশ্রমিক এবং বড় বড় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ দিয়ে জিদানীর কমিশন কিছু পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের তাদের কনফারেন্সগুলোতে টেনে আনলেন। জিদানী বিজ্ঞানীদের “সম্পূর্ণ” নিরপেক্ষ থাকার আশ্বাস দেন এবং মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য করেন যে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা রয়েছে।
এই কনফারেন্সের ভিডিও ফুটেজ দিয়ে জিদানী একটি ভিডিও উপস্থাপন করেন যেখানে গর্ব করা হয় যে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা সুনিশ্চিত করেছে যে কোরআনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক বিস্ময় রয়েছে। সেই কনফারেন্স অংশগ্রহণকারী অনেকেই তাদেরকে এই রকম উক্তি করতে প্ররোচিত করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানী উইলিয়াম হেয় মন্তব্য করেন, “I fell into that trap and then warned other people to watch out for it”৮ [“আমি সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলাম এবং পরে অন্যদের সাবধান করে দিলাম”]। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রবন্ধ এইভাবে বর্ণনা করেন:
Gerald Goeringer, an embryologist retired from Georgetown University, says he urged the commission to try some verification: hire an independent scholar to see whether the Quran’s statements could have been taken from Aristotle, the Greek philosopher-scientist who preceded the book by nearly 1,000 years. After his request was denied, Goeringer says, he stopped going to the conferences for fear of being associated with fanaticism.“It was mutual manipulation,” he says. “We got to go places we wouldn’t otherwise go to. They wanted to add some respectability to what they were publishing.”
৯
[জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ভ্রুণবিদ্যার বিশেষজ্ঞ জেরাল্ড গরিঙ্গার বলেন তিনি জিদানীর কমিশনকে কিছু সত্যাসত্য নির্ধারণ করতে অনুরোধ করেছেন – একজন নিরপেক্ষ গবেষককে নিযুক্ত করা উচিত, যিনি গবেষণা করবেন কোরআনের উদ্ধৃতিগুলো কোরআনের লেখার ১০০০ বছর আগে গ্রীক দার্শনিক-বিজ্ঞানী এরিস্টটোলের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে কী না তা যাচাই করতে। তার এই অনুরোধ না রাখাতে তিনি সেই কমিশনে যাওয়া বন্ধ করে দেন, এই ভয়ে যেন তিনি অযৌক্তিক গোঁড়ামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে না পড়েন।
“এটি ছিল দুপক্ষ পরস্পরকে নিজ সুবিধায় ব্যবহার করা,” তিনি বলেন। “আমরা তাদের খরচে নতুন নতুন দেশে ভ্রমণ করতে পেরেছি। তারা যে তথ্য প্রকাশ করছিল তা আমাদের দিয়ে সম্মান বাড়াতে চাচ্ছিল।]
এই জিদানী ওসামা বিন লাদেনের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও উপদেষ্টা ছিলেন। বিন লাদেন নিজেই ছিলেন বুকাইলিবাদের অন্যতম প্রথম ভক্ত, এবং এর ‘গবেষণার’ অর্থযোগানদাতা। জিদানী ও কিথ মওরের ভ্রূণতত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকে অর্থ সাহায্যদানকারী লোকদের তালিকায় প্রধান দাতা হিসেবে বিন লাদেনের নাম রয়েছে। ইউসুফ বোডানস্কি, বিন লাদেনের জীবনীকার, লিখেছেন যে পৃথিবীর এই মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান, তার পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলাগুলো ইসলামের সাথে সুসংগত কিনা তা জানতে নিয়মিত জিদানীর পথনির্দেশ মেনে চলতেন। হাসান এ.এ. বাহাফ্জাল্লাহ্ জিদানী ও বিন লাদেনের সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, “আমি যেটুকু জানি আফগানিস্তানে জিহাদ চলাকালে জিদানী বিন লাদেনকে মাঝে মাঝে দেখতে যেতেন”। ১৯৯৫ সালে জিদানী তার কমিশন থেকে সরে আসেন এবং বর্তমানে ইয়েমেনে ইসলামী আইন চালু করার কাজে ব্যস্ত।
বেদ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যে “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়”
ধর্মগ্রন্থে আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজে বেড়ানো কেবল ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- আমরা সেই একই প্রচেষ্টা হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যেও দেখি। কিছু কিছু হিন্দু রক্ষণশীলদের মতে বেদ শাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে কোয়ার্ক, পার্টিকাল থিওরী এবং কোয়ান্টাম মেক্যানিক্সের বর্ণনা। জে.সি. চট্টোপাধ্যায়ের লিখিত The Wisdom of the Vedas বইতে এই ধরনের দাবি করা হয়েছে। পদ্ধতি ঠিক বুকাইলিবাদের মতো, কিন্তু ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ আলাদা হলেও ফলাফলটা একই।
ধর্মীয় কট্টোরপন্থী লোকদের বাইরে, বুকাইলিবাদকে আরও বেশি অবজ্ঞা করা হয়। একজন সমালোচক একটি হাস্যকর প্যারডি সংকলন করেছেন, ল্যাটিন পৌত্তলিক কবি ভার্জিলের জোর্জিকা রচনার প্রথম মাত্র ক’য়েক লাইনে তিনি দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের পর বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের প্রমান দেখায়।
কিছু বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের বিশ্লেষণ
আমরা যদি সমস্ত দাবি করা বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের উদাহরণ দেখি, এগুলো সবই ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। এই বিশ্লেষণ কোরআনকে আক্রমণ করছে না; এ বিশ্লেষণ শুধু কোরআন শরীফের আধুনিক অপব্যাখ্যা ভুলপ্রমান করছে। এইসব বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের ভুলপ্রমাণ করার ঝুঁকি হল যে অনেক মুসলমান মনে করেন সেটা কোরআনের বিরুদ্ধে হামলা, যা আসলে ঠিক না। সেইজন্যেই মাওলানা থানভী কোরআনে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের অনুসন্ধানে নিরুৎসাহিত করেছেন, কারণ সেগুলো যখন ভুলপ্রমাণ হয় তখন লোক হয়তো কোরআনও অস্বীকার করবে। এই রকম ধারণা প্রকৃত পক্ষে সবচেয়ে ভাল মুসলিম চিন্তাবিদরাই পোষণ করে থাকেন।
বৈজ্ঞানিক বিস্ময় #১ : চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো
আসুন আমরা তাহলে জাকির নায়েকের উপস্থাপিত কোরআনে চাঁদের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিস্ময় দিয়ে শুরু করি—
চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো
– আগের সভ্যতার মানুষদের ধারণা ছিল, চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। কিন্তু বিজ্ঞান বর্তমানে আমাদেরকে বলে যে, চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো। এ সত্যটি কোরআন আমাদেরকে আজ থেকে ১৪শ বছর আগে বলেছে নিম্ন আয়াতে:
“কত মহান তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করিয়াছেন রাশিচক্র এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।”
(সূরা ফুরকান ২৫:৬১)
আরবীতে সূর্যকে ‘শাম্স’ বলে। ‘সিরাজ’ শব্দ দ্বারাও সূর্য বুঝানো হয়েছে… চাঁদের আরবী প্রতিশব্দ হল ‘ক্বামার’ এবং কোরআনে চাঁদকে ‘মুনীর’ বলেছে। এর অর্থ হল ‘নূর’- আলো দানকারী, অর্থাৎ প্রতিফলিত আলো দেয়… এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআন সূর্য ও চাঁদের আলোর মধ্যকার পার্থক্যকে স্বীকার করে। ১০
জাকির নায়েকের এই ব্যাখ্যার প্রধান সমস্যাটা হলো যে আরবী “নূর”(نُور) শব্দটার অভিধানিক অর্থ শুধু “আলো”; এই শব্দ দিয়ে যে, “প্রতিফলিত” হওয়া বোঝা তা কোন আরবী অভিধান বা শব্দকোষে নেই। কিন্তু যুক্তিতর্কের খাতিরে আমরা যদি নায়েকের শব্দার্থগুলো ধরে নিই, তাহলে এই কথাও বলতে হবে যে আল্লাহতা’লা যার উপাধি “আন-নূর”, তিনি হচ্ছে “প্রতিফলিত আলো” এবং মুহাম্মদ (সাঃ) (যাকে সূরা আহ্যাব ৪৬ আয়াতে বলা হয় “সিরাজ”) তিনি হচ্ছে আলোর উৎস। তাহলে এই শব্দার্থ ধরে নিলে আল্লাহ্ হচ্ছে শুধু প্রতিফলিত আলো এবং মুহাম্মদ হচ্ছে আসল আলোর উৎস। নায়েকের এই দূর্বল নতুন শব্দার্থ মেনে নিলে মুহাম্মদকে আল্লাহ্র উপরে তোলা হয়।
আবার ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কোরআন নাজেলের এক হাজার বছর আগেও মানব সমাজ জানতো যে চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো। এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রীষ্টপূর্ব) পৃথিবী গোলাকার প্রমান করলেন এই যুক্তিতে, যে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া দেখা যায়—চাঁদের আলো যে প্রতিফলিত আলো এরিস্টটলের কাছে সেটা সোজা জ্ঞান ছিল। মুহাম্মদ(স)-এর শত বছর আগে ইহুদীরাও জানতো যে চাঁদের কোন নিজেস্ব আলো নেই বরং সে সূর্যের কাছ থেকে “আলো ধার নেয়” (Philo, 1st century) এবং “চাঁদের আলো সূর্যের আলো থেকেই বের হয়ে আসে” (Midrash Hagadol, ~১০০ খ্রীঃ)
বৈজ্ঞানিক বিস্ময় #২ : মাতৃগর্ভে ভ্রুণের পর্যায়গুলো
ডঃ মরিস বুকাইলি আর ডঃ কিথ এল মুর, মাতৃগর্ভে মানব ভ্রুণ যে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পায় এবং কোরআন যে বিস্ময়কর ভাবে তার বর্ণনা দেয়, এই ধারণা জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেনঃ
“আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি মৃত্তিকার উপাদান হইতে, অতঃপর আমি উহাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধাঁরে; পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি “আলাক”-এ, অতঃপর আলাক্কে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে; অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢাকিয়া দেই গোশ্ত দ্বারা; অবশেষে উহাকে গড়িয়া তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্ কত মহান!” (সূরা মু’মিনূন ২৩:১২-১৪)
তাহলে আমরা দেখি যে কোরআনে চারটি ধাপের বর্ণনা রয়েছে—
তৃতীয় ধাপ : মুদাঘা (مُضْغَه) – গোশতের খণ্ড বা পিণ্ড
চতুর্থ ধাপ : ‘আদাম (عَظَمَ) – হাড়
পঞ্চম ধাপ : গোশত দিয়ে হাড়কে ঢেকে দেওয়া।
দাবি করা হয় যে, যেহেতু মানব ভ্রূণের এই ধাপগুলো কেবলমাত্র গত শতকে আবিস্কার করা হয়েছে, তাই কোরআন শরীফ যে এই তথ্য ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে উল্লেখ করেছে তা এক অলৌকিক বৈজ্ঞানিক বিস্ময়। কিন্তু যেহেতু ‘আলাক্বা (عَلَق) আরবী শব্দের প্রকৃত অর্থ “রক্তপিণ্ড” বলে ভ্রুণের কোন ধাপ নেই, বুকাইলি এই ‘আলাক্বা শব্দের এক নতুন মানে উদ্ভাবন করেন যা হচ্ছে “কোন কিছু যা লেগে থাকে” অথবা “জোঁকের মতো বস্তু”।
এই আয়াতগুলো বৈজ্ঞানিক বিস্ময় হিসেবে প্রচারে অনেক সমস্যা রয়েছে—
প্রথম ধাপ : বীর্য
দ্বিতীয় ধাপ : মাসিক রক্ত
তৃতীয় ধাপ : মাংস
চতুর্থ ধাপ : হাড়
পঞ্চম ধাপ : গোশত দিয়ে হাড়কে ঢেকে দেওয়া
৫. বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক সহীহ হাদিসে কোরআনের এই ধাপগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে, যেখানে বলা হয় ভ্রূণ বৃদ্ধির প্রথম তিনটি ধাপের মেয়াদ হল ৪০ দিন করে। ডঃ বুকাইলিও মানতে বাধ্য হয়েছে যে, “এখানে ভ্রূণ সম্পর্কে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের সাথে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” ১২
৬. এই “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়” সমর্থন হিসেবে জাকির নায়েক প্রায়ই পশ্চিমা ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ Dr Joe Leigh Simpson এর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন। কিন্তু পরে ডঃ সিম্প্সন তার নিজের সেই মন্তব্যগুলোকে বলেছে “বোকা এবং লজ্জাকর”।১৩
বৈজ্ঞানিক বিস্ময় # ৩ : পিঁপড়াদের আন্তঃসংযোগ
নিম্ন অনুচ্ছেদে ডঃ জাকির নায়েকের ধারণায় আরেকটি বৈজ্ঞানিক বিস্ময় লুকিয়ে আছে—
“সোলায়মানের সামনে তার সেনাবাহিনীকে জড় করা হল। জ্বিন,মানুষ ও পক্ষীকূলকে, অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হল। যখন তারা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌছল, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকার দল, তোমরা তোমাদের ঘরে প্রবেশ কর। অন্যথায়,সোলায়মান ও তাঁর বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে।” [সূরা আন নামল-১৭-১৮]
[জাকির নায়েক:] অতীতে কেউ হয়তো কোরআনের প্রতি এই বলে উপহাস করে থাকতে পারে যে, কোরআন যাদুকরী কাহিনীর বই, যাতে পিঁপড়ার পরস্পরের কথা এবং উন্নত বার্তা বিনিময়ের বিষয় উল্লেখ আছে। সম্প্রতি, গবেষণায় পিঁপড়ার জীবনধারা সম্পর্কে এমন সব বাস্তব সত্য উদঘাটিত হয়েছে, যা আগে মানুষ জানত না।
কিন্তু পিঁপড়াদের মধ্যে যে যোগাযোগ-সম্বন্ধ আছে তা উপলব্ধি করা সাধারণ জ্ঞান ছাড়া কিছুই নয়, এটা তো কোন দশ বছরের বাচ্চাও নিজে নিজে বের করতে পারে।
জাকির নায়েক এই পুরা অনুচ্ছেদের অন্য অংশ নিয়ে আলোচনা করেন না, যেখানে সোলায়মান নবী রাজনৈতিক ও অধিবিদ্যাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে হুদ্হুদ্ পাখি (২২-২৮ আয়াত) ও ‘ইফ্রিত (عفريت, একটি ডানাযুক্ত গুহাবাসী জিন – ৩৯ আয়াতে) এর সঙ্গে আলোচনা করেন। আল্লাহ্ এইভাবে পাখি ও পিঁপড়াকে এসব জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার অলৌকিক ক্ষমতা দিতে সক্ষম, কিন্তু এই অলৌকিক আলোচনার বর্ণনাকে ‘বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’ বলা বোকামি ছাড়া কিছু না।
উল্লেখ্য যে তৌরাত শরীফে সোলাইমানের জীবনীতে সোলায়মানকে পিঁপড়া, হুদ্হুদ্ অথবা ইফ্রিতের সাথে কথাবার্তার উল্লেখ নেই, বরং তাঁকে প্রাণীজগৎকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা করার কথা বলা হয়েছে—
“তিনি লেবাননের এরস গাছ থেকে শুরু করে দেয়ালের গায়ে গজানো হিস্যোপ গাছ পর্যন্ত সমস্ত গাছের বর্ণনা করেছেন। তিনি জীব-জন্তু, পাখী, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও মাছেরও বর্ণনা করেছেন। দুনিয়ার যে সব বাদশাহ্রা সোলায়মানের জ্ঞানের বিষয় শুনেছিলেন তাঁরা তাঁর জ্ঞানপূর্ণ কথা শুনবার জন্য লোকদের পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে সমস্ত জাতির লোক তাঁর কাছে আসত।” (১ বাদশাহ্নামা ৪:৩৩-৩৪)
* * *
কিতাব ও বিজ্ঞান কি
পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ ?
কোন্ ধর্মগ্রন্থ বেশী বিজ্ঞাননির্ভর এই নিয়ে কিছু মুসলমান এবং খ্রীষ্টান লোক প্রায়ই তর্কাতর্কি করে থাকে। আমরা সকলে এই জানি যে, একই আল্লাহ্ যিনি প্রাকৃতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন তিনিই কিতাব নাজিল করেছেন, তাই বিজ্ঞান ও আল্লাহ্র বাণীর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকার কথা। কিন্তু আবার উভয় কিতাবে, অর্থাৎ বাইবেল ও কোরআনে কিছু কিছু অনুচ্ছেদ আছে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিজ্ঞাননির্ভর নয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে কঠিন অনুচ্ছেদ এবং বর্ণনা আসলে উভয় কিতাবে আছ—
বাইবেল ও কোরআনে আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক ঘটনা—
– ঈসা মসীহের মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করা
– ঈসা মসীহের অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি দান করা
জিন, বদ-রূহ্ এবং ফেরেশতা – প্রত্যেক কিতাবে এই রূহানিক জীবদের অস্তিত্ব গ্রহণ করে, যারা মাঝে মাঝে পার্থিব রূপ ধারণ করে মানুষের কাছে ধরা দেয়।
মৃত্যুপরবর্তী জীবন – মৃত্যুর পরে মানুষের পচে যাওয়া মস্তিষ্ক যে এক রূহানিক সত্ত্বাতে পরিণত হতে পারে এই ধ্যান-ধারণা আপাতদৃষ্টিতে অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, তবুও আমরা বিশ্বাস করি যে সৃষ্টিকর্তা এমন কাজ করতে সক্ষম।
অকৃত্রিম ঈমানদারগণ এই ধরণের সমস্যাগুলো অন্ধভাবে অস্বীকার করে না বরং গভীরভাবে চিন্তা করে এদের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে নেয়। সৎ হলে আমরা স্বীকার করব যে এইগুলো সত্যই কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু সঠিক ব্যাখ্যায় কিতাবুল মোকাদ্দস (অর্থাৎ বাইবেল) বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন করে নিম্ন আলোচনায় দেখানো হবে।
সৃষ্টি ও বিজ্ঞান
জাকির নায়েকের মতো সমালোচক প্রায়ই দাবি করে বলেন যে বাইবেল অনুযায়ী পৃথিবী ৬টি আক্ষরিক দিনে সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু কোরআন অনুযায়ী সৃষ্টি দিনগুলো আসলে ‘যুগ’। এ দাবিগুলো পরিষ্কাররূপে মিথ্যা—
পয়দায়েশ খণ্ডে তৌরাত শরীফের বর্ণনা দীর্ঘস্থায়ী পৃথিবীর অস্তিত্বের সঙ্গে মিলানোর দুটি ব্যাখ্যার পন্থা আছে। আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে মিলানোর প্রচেষ্টা এগুলো নয়, কারণ উভয় মতবাদের মূল থাকে প্রাচীনকাল লেখকদের লেখাতে, যারা আজকাল দীর্ঘস্থায়ী পৃথিবী তথ্য আবিষ্কারের বহুদিন আগে এই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
পয়দায়েশের প্রথম ব্যাখ্যা : দিন-যুগ ব্যাখ্যাটি
পয়দায়েশের প্রথম অধ্যায়ে “দিনের” মূল হিব্রু শব্দ হল ইয়ম (হিব্রু יום), যেমন করে কোরআনেও একই “দিন” শব্দ (يَوْم ইয়োম ) ব্যবহার হয়েছে। উভয় ভাষায়ই, এই ইয়ম শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় ১২ ঘন্টা, ২৪ ঘন্টা, অথবা একটা অনির্দিষ্ট মেয়াদ বা যুগ।১৪ আবার কিতাবুল মোকাদ্দসে আমরা পড়ি যে “প্রভুর কাছে এক দিন এক হাজার বছরের সমান এবং এক হাজার বছর এক দিনের সমান” (ইঞ্জিল ২ পিতর ৩:৮ এবং জবুর শরীফ ৯০:৪)।১৫ আবারও তৌরাতে যে শব্দগুলো অনুবাদ হয় “সকাল” (בקר) ও “সন্ধ্যা” (ערב) দিয়ে, সেগুলোর আবার শুধু বোঝায় “ইয়মের শুরু” এবং “ইয়মের শেষ”,১৬ যেমন করে বলা হয় ‘the dawn of world history’ [বিশ্ব-ইতিহাসের ভোর] অথবা ‘ the sunset years of one’s life’ [একজনের জীবনের সূর্যাস্ত বছরগুলো]। লেখক যে আক্ষরিক সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত বুঝাতে চাননি তা অতি পরিষ্কার, কারণ চতুর্থ দিনে সূর্য দেখা দেওয়ার আগেও তিনি এই בקר ও ערב শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন।
তৌরাতে সৃষ্টির এই দিন-যুগ ব্যাখ্যার সবচেয়ে মজবুত প্রমাণ হল যে ঈসায়ী ইতিহাসের প্রথম ৪০০ বছর ধরে অধিকাংশ তৌরাত-তাফসীরকারীগণ সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতেন যে সৃষ্টির এই ‘দিন’ বা ‘ইয়ম’গুলো দীর্ঘ সময়ের মেয়াদ ছিল (যেমন প্রতি ইয়মের কাল ১০০০ বছর)।১৭ এসব দুই হাজার পৃষ্টার তাফসীর লেখা হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্যের হাজার বছর আগে, যখন সৃষ্টিতে দিনের দীর্ঘতা বিশ্বাস করার কোনো দ্বিতীয় কারণ ছিল না।
কিন্তু সহীহ হাদিস অনুযায়ী, কোরআনের সৃষ্টি-দিনগুলোর সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাখ্যা ছিল আক্ষরিক- ‘শনিবার, রবিবার, সোমবার’, ইত্যাদি হিসেবে ধরে নিয়েছেন:
আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছ) আমার হাত ধরে বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা শনিবার দিন মাটি সৃষ্টি করেন। রোববার দিন তিনি এতে পর্বত স্থাপন করেন। সোমবার দিন তিনি বৃক্ষরাজি পয়দা করেন। মঙ্গলবার দিন তিনি আপদ বিপদ সৃষ্টি করেন। বুধবার দিন তিনি নূর পয়দা করেন। বৃহস্পতিবার দিন তিনি যমীনে পশু-পাখি ছড়িয়ে দেন এবং জুম’আর দিন আসরের পর তিনি আদম (আ) কে সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ জুম’আর দিনের সময়সমূহের শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাখলুক আসর থেকে রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ মুসলিম #৬৮৮৭)১৮
প্রথম তাফসীরকারীগণ একই ব্যাখ্যা দিলেন; আল-তাবারীতে ইবন আব্বাসের এই কথা আছে—
ইহুদীগণ নবীজীর কাছে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন আসমান ও জমীনের সৃষ্টির সম্পর্কে। তিনি বলেন, “রবিবার ও সোমবারে আল্লাহ্ তা’আলা দুনিয়া সৃষ্টি করেন। মঙ্গলবারে তিনি পাহাড়পর্বত এবং এদের ব্যবহার সৃষ্টি করেন। বুধবারে তিনি গাছ, পানি, শহর এবং চাষের অনুর্বর জমি সৃষ্টি করেন। এগুলো চার (দিন)। তিনি আবার বললেন (কোরআন উদ্ধৃতি করে): “বল, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষে দাঁড় করাইতেছ? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক! তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চারি দিনের মধ্যে তাতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের সমভাবে যাচ্নাকারীদের জন্য” – বৃহস্পতিবারে, তিনি আসমান সৃষ্টি করেন। শুক্রবারে, ৩ ঘণ্টা বাকি থাকা পর্যন্ত তিনি তারা, সূর্য, চাঁদ, এবং ফেরেশতা তৈরী করেন।” ১৯
যেহেতু ইসলাম অনুযায়ী কোরআনের প্রথম সঠিক ব্যাখ্যার উৎস হল সহীহ্ হাদিস, সেহেতু জাকির নায়েকের ব্যাখ্যা না মেনে বিশ্বাস করতেই হবে যে কোরআন সৃষ্টির সময়কালকে ২৪-ঘন্টার দিন হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হয়।
কিছু সমালোচক হয়তো অভিযোগ করবেন যে তৌরাতের ৬-দিন সৃষ্টি যেহেতু কাজের সপ্তাহের মত, সেহেতু সেটা ২৪-ঘণ্টা দিন হতে হবে। সেটা সত্য যে পয়দায়েশের ৬ দিন সপ্তাহের ৬ দিনের সাথে তুলনা করা হয় (হিজরত ২০:১১)। কিন্তু তৌরাতের অন্যান্য অনুচ্ছেদ থেকে বোঝা যায় যে এই ধরণের সংখ্যার তুলনা আক্ষরিক অর্থ বোঝা উচিত নয়, অর্থাৎ সৃষ্টির ছয় “ইয়োম” যে সপ্তাহের ছয় দিনের সাথে তুলনা করা হয়, তার মানে এই না যে সৃষ্টির “ইয়োম” হল আক্ষরিক ২৪-ঘণ্টার দিন-রাত। যেমন তৌরাতের অন্য আয়াতে ৪০ দিনের জন্য অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলা বনি-ইসরাইলকে ৪০ বছরের মরুভূমিতে নির্বাসনে পাঠালেন (শুমারী ১৪:৩৪), অথবা দানিয়াল ৯:২৪-২৭ এতে ৪৯০ দিন কে বোঝানো হয় ৪৯০ বছর ।
পয়দায়েশের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা : সাহিত্যিক কাঠামোর ব্যাখ্যা
(Literary Framework Interpretation)
অনেক বিশিষ্ট তৌরাত তাফসীরকারী পয়দায়েশর সৃষ্টি অনুচ্ছেদকে রূহানিক বিষয়ক একটা দৃষ্টিসম্বন্ধী কাব্যিক চিত্র হিসেবে ধরে; যার আক্ষরিক বা কালানুক্রমিকভাবে ব্যাখ্যা করা অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যের বাইরে পড়ে। এই অধ্যায়ের কাব্যিক কাঠামো সুস্পষ্ট:
গঠনের দিনগুলো : |
ভরানোর দিনগুলো : |
---|---|
দিন ১: “আলো” (৩ আয়াত) | দিন ৪: “আলোগুলো” (১৪ আয়াত) |
দিন ২: “বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্র” (৭ আয়াত) |
দিন ৫: “পাখি ও মাছ “(২১ আয়াত) |
দিন ৩ক: “ভুমি” (৯ আয়াত) | দিন ৬ক: “পশু” (২৪ আয়াত)“মানুষ” (২৬ আয়াত) |
দিন ৩খ: “গাছপালা” (১১ আয়াত) | দিন ৬খ: “শাক-সবজী দেওয়া” (৩০ আয়াত) |
এই চিন্তাধারা অনুযায়ী, “দিন”কে একটা রূপক কাব্যিক কাঠামো হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। একটি কিতাবকে তার মূল সংস্কৃতি ও ভাষার নিয়ম অনুসারে ব্যাখ্যা করতে হয়, এবং আমরা জানি যে হিব্রু সাহিত্যে ঘটনা ধর্মীয় গুরুত্বের ক্রমে লেখা হতো, কালানুক্রমিকভাবে নয়। হিব্রু লেখক মথির সুসমাচারে আমরা একটি স্পষ্ট উদাহরণ পাই-ঈসা মসীহের জীবনের ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে ধর্মতত্ত্বীয় বিষয় অনুসারে, যদিও লেখার মধ্যে কালানুক্রমিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক রীতির কাছে এটা অদ্ভুত লাগে, কিন্তু সেটা হিব্রু সাহিত্যের একটি ধরণ।
আমরা যদি কিতাবের জন্য সবসময় আক্ষরিক কালানুক্রমিক ধারা কঠোরভাবে দাবী করি, তাহলে কোরআনের বেলায়ও সমস্যার সম্মুখীন হই। আমরা যদি সূরা ৪১:৯-১২ এর সৃষ্টির দিনগুলো যোগ করি আমরা আট দিন পাই (২+৪+২), যদিও কোরআনের অন্য আয়াত অনুযায়ী সৃষ্টি ৬ দিনে হল (৭:৫৪, ১০:৩, ১১:৭, ২৫:৫৯)। আমরা কিতাবকে সবসময় পারম্পারিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না।
পয়দায়েশের দিনগুলোর ক্রম
সমালোচকগণ দুনিয়া সৃষ্টির পর্যায়ক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই ‘রাত-দিন’ হতে পারে, অথবা কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই গাছ-পালা পৃথিবীতে জন্মাতে পারে। পয়দায়েশের ধাপগুলোর নিম্নের ব্যাখ্যা এসব ভুল ধারণাগুলোকে দূর করে।
মূলতঃ পয়দায়েশের প্রথম আয়াত যে দৃষ্টিকোণ স্থাপন করেছে তা হল পৃথিবীর পানির তল থেকে, যেখানে সৃষ্টির শেষে মানুষকে রাখা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির সব ধাপগুলো বর্ণনা করা হয় পয়দায়েশের প্রথম অধ্যায়ে, কোনো কাল্পনিক দূর মহাকাশে অবস্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। সঠিক দৃষ্টিকোণ বা দেখার অবস্থান পেলে সৃষ্টির ধাপগুলোর ক্রম নিয়ে অনেক ভুলধারণা দূর হয়ে যায়:২০
বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথ্য : |
পয়দায়েশের বর্ণনা : |
---|---|
সৃষ্টির শুরু (১৪০০ কোটি বছর আগে)– বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি মহা বিস্ফোরণে সমস্ত কিছু শুরু হল। |
“সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ্ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন।” (১ আয়াত) |
পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থা (৪৫০ কোটি বছর আগে) আধুনিক বিজ্ঞানের মতে প্রথমে পৃথিবীর চারদিকে এতো বেশী আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা ছিল যে পৃথিবীর তলের অবস্থা পুরোপুরি অন্ধকার ও বিশৃঙ্খল ছিল। এই তথ্য পয়দায়েশ ১:১-২ বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়: |
“দুনিয়ার উপরটা তখনও কোন বিশেষ আকার পায় নি, আর তার মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না; তার উপরে ছিল অন্ধকারে ঢাকা গভীর পানি। আল্লাহ্র রূহ্ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন।” (২ আয়াত) |
বিশৃঙ্খলের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার ধাপগুলো : |
|
প্রথম ধাপ:পৃথিবীর তলে দিনরাত উপলব্ধি (৪৫০-৩০০ কোটি বছর আগে) আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা আংশিক ভাবে অপসারিত হয় এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আংশিক ভাবে রুপান্তর হয় যেন মহাকাশের আলো ঢুকে সমুদ্রের তল দেখা যায়। |
প্রথম ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ বললেন, “আলো হোক।” আর তাতে আলো হল। তিনি দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে আলোর নাম দিলেন দিন আর অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল আর সকালও গেল, আর সেটাই ছিল প্রথম দিন।” (৩-৫ আয়াত) |
দ্বিতীয় ধাপ: সমুদ্র-বায়ুমণ্ডল পৃথক হয়ে যাওয়া (৩০০-২০০ কোটি বছর আগে) বায়ুমণ্ডলের ক্রান্তি মন্ডলে (troposphere) বাষ্প গঠন হয় যেন স্থিতিশীল পানির চক্র প্রতিষ্ঠিত হয় |
দ্বিতীয় ‘ইয়ম’: “…তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হোক, আর তাতে পানি দু’ভাগ হয়ে যাক…” (৬-৮ আয়াত) |
তৃতীয় ধাপ: মহাদেশ ও সমুদ্র আলাদা, উদ্ভিদ (২০০-৭০ কোটি বছর আগে) মহাদেশগুলো ভাগ হয়ে সমুদ্র ও মহাদেশে আলাদা হয়ে যায়, এবং প্রথম উদ্ভিদ ও গাছ জন্মায় |
তৃতীয় ‘ইয়ম’: “…এর পর আল্লাহ্ বললেন, “আসমানের নীচের সব পানি এক জায়গায় জমা হোক এবং শুকনা জায়গা দেখা দিক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্ সেই শুকনা জায়গার নাম দিলেন ভূমি, আর সেই জমা হওয়া পানির নাম দিলেন সমুদ্র।” (৯, ১০ আয়াত) |
চতুর্থ ধাপ: বায়ুমণ্ডলের রূপান্তর – সূর্য, চাঁদ ও তারা দেখা যায় (৭০-৬০ কোটি বছর আগে) এর আগে বায়ুমণ্ডল আলোকপ্রবাহী ছিল কিন্তু অস্বচ্ছ, অর্থাৎ আলো ঢুকে যেত কিন্তু সূর্যচন্দ্র দেখা যেত না; এই ধাপে বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ হয় এবং সূর্যচন্দ্র স্পষ্টভাবে দেখা যায়। |
চতুর্থ ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন (עשׂה – প্রকাশ করলেন)। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন।” (১৬ আয়াত) |
পঞ্চম ধাপ: পানির মধ্যে জীব, প্রাণী (৬০-২০ কোটি বছর আগে) ছোট সামুদ্রিক প্রাণীর বিবর্তন হয় |
পঞ্চম ‘ইয়ম’: “তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানি বিভিন্ন প্রাণীর ঝাঁকে ভরে উঠুক, আর দুনিয়ার উপরে আসমানের মধ্যে বিভিন্ন পাখী উড়ে বেড়াক।” (২০ আয়াত) |
ষষ্ঠ ধাপ: স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং মানব জাতি (২০-১ কোটি বছর আগে) স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর বিবর্তন এবং homo sapien এর উত্থান। |
ষষ্ঠ ‘ইয়ম’: “আল্লাহ্ দুনিয়ার সব রকমের বন্য, গৃহপালিত এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী সৃষ্টি করলেন…পরে আল্লাহ্ তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন।” (২৫,২৭ আয়াত) |
কোরআন ও তৌরাত উভয় কিতাবেই আছে সমতুল্য কিছু রহস্যময় ঘটনার পর্যায়ক্রম। কোরআন শরীফের প্রধান সৃষ্টি-বর্ণনা সূরা ৪১:৯-১২ আয়াত অনুযায়ী, সাতটি আসমানের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সৃষ্টির পরে, যদিও বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী আসমান সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টির কোটি কোটি বছর পূর্বে। সূরা বাকারাহ্ ২৯ আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে—
“তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন।” (বাকারাহ্ ২৮)
তাহলে কোরআনের মধ্যেও আমরা এমন কালানুক্রমিক জটিলতা দেখতে পাই। তার মানে এই নয়, যে কোরআন ভুল, বরং আমরা দেখি যে সব কিতাবের মধ্যে কিছু জটিল বিষয় থাকে।
কিছু সমালোচক বলেন যে চতুর্থ দিনে সূর্য, চন্দ্র ও তারার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘তৈরী করা’, ‘দৃশ্যমান করা’ নয়। আসলে কিন্তু, এখানে হিব্রু “সৃষ্টি” বা “তৈরী” শব্দটি ব্যবহার হয় নি (בּרא, বারা), বরং עשׂה (‛আসাহ্) শব্দ ব্যবহার হয়েছে এখানে, যার অর্থ হতে পারে “দৃশ্যমান করা।” এই শব্দটি হিব্রু কিতাবে ১২০০ বার ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক ধরনের মানে বহন করে, যাদের মধ্যে “করা”, “তৈরি করা”, “দেখানো”, “আবির্ভাব”, “আবির্ভূত করা” ইত্যাদি। এই যুক্তির আলোকে আমরা অবশ্যই এই বলে শেষ করতে পারি যে সূর্য এবং চাঁদ প্রথম দিনে সৃষ্টি (৩য় আয়াত) হয়ে থাকলেও, চতুর্থ দিনে সূর্য এবং চাঁদ পৃথিবীর তলে দৃশ্যমান হয়।
জাকির নায়েক তৌরাতের বর্ণনা সমালোচনা করে বলেন যে সূর্য সৃষ্টির আগে গাছপালা সৃষ্টি করা অসম্ভব। উপরের বর্ণনায় সমস্যা সমাধান হলেও, আমরা সহীহ্ হাদিস ও আল-তাবারীর বিবরণে একই জিনিস দেখি যে, সেখানেও সূর্য সৃষ্টির দুই দিন আগেই গাছপালা সৃষ্টি হয়েছে। উপরোক্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে জানা যায় যে উদ্ভিদের বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে বায়ুমণ্ডল দিয়ে আলো আসতো কিন্তু পৃথিবীর তল থেকে সূর্য দেখা যেত না। চতুর্থ দিনে বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ হয়ে সূর্য ও চাঁদ দৃশ্যমান হয়। এই আংশিক আলোতে সালোকসংশ্লেষণ সম্ভব হয়ে উদ্ভিদের বিবর্তন হয়, যার বৃদ্ধির ফলে অক্সিজেনযুক্তকরণ হয় যেন বায়ুমণ্ডল পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়। ডঃ রবার্ট সি নিউম্যান (কোর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. প্রাপ্ত) বলেন,
“vegetation was the immediate cause of both the oxygenation of the atmosphere and the removal of its heavy cloud cover.” [“উদ্ভিদগণই বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনযুক্তকরণ ও বায়ুমণ্ডলের ভারী মেঘ সরে যাওয়ার প্রধান কারণ।”] ২১
বিশ্বতত্ত্ব: পৃথিবী সমতল না গোলাকার?
পৃথিবী সমতল না গোলাকার?
“তুমি কি দেখ না আল্লাহ্ রাত্রিকে দিবসে এবং দিবসকে রাত্রিতে পরিণত করেন?”
(সূরা লুক্মান ৩১:২৯)
নায়েক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন যে উপরোল্লেখিত আয়াত একটি বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, কারণ “দিবসকে রাত্রিতে পরিণত করেন” দিয়ে বোঝা যাচ্ছে যে পৃথিবী গোলাকার। আসলে, এখানে কোরআন শরীফ সাধারণ জ্ঞানের একটি বর্ণনা দিচ্ছে, যে দিন হঠাৎ করে রাত হয় না বরণ অন্ধকার আস্তে আস্তে আসে। কোরআন শরীফ যে পৃথিবী গোলাকার বলেন তা প্রমাণ করতে জাকির নায়েক আর একটি আয়াত ব্যবহার করেন—
“…এবং পৃথিবীকে ইহার পর বিস্তৃত করিয়াছেন।” (সূরা নাযি’আত ৭৯:৩০)
নায়েক এখানে আরবী শব্দের জন্য একটি নতুন মনগড়া “অর্থ” আবিষ্কার করেছেন। বিভিন্ন শব্দ যার অর্থগুলো শত শত বছর ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত হঠাৎ করে তিনি তাঁর ‘বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের’ প্রমাণ হিসেবে সেগুলোর অর্থ পরিবর্তন করেন। কারণ এইভাবে, সূরা ৭৯:৩০ সবসময় “বিস্তৃত” দিয়ে অনুবাদ হয়ে আসছে, কিন্তু নায়েক বলেন যে دَحَهَا (“দাহাহা”) শব্দের আসল অর্থ হল “বিস্তৃত” নয় বরং “উটপাখির ডিম” (!), এবং এইভাবে নায়েকের নতুন অনুবাদ হয়, “এবং পৃথিবীকে ইহার পর ডিম-আকারে সৃষ্টি করেছেন।”
কোনো স্বীকৃত আরবী অভিধান নাই যেখানে دَحَهَا শব্দটির অর্থ দেওয়া হয় “উটপাখির ডিম।” গত ২০-৩০ বছরের আগে, কোনো আরব আলেম নাই যারা এমনভাবে এই আয়াতটি অনুবাদ করেছেন; যেমন ইউসুফ আলী, পিক্থাল, শাকির, আসাদ, এবং দাউদ, যারা সারা জীবন ব্যয় করেছেন কোরআনের সঠিক অনুবাদ করতে। আমরা কাকে বিশ্বাস করব—এদের মত প্রকৃত কোরআনি-আরবীর ভাষাতত্ত্ববিদ, নাকি নায়েকের মত একজন ওয়াহাবী টেলিভিশন প্রচারক? আব্দুল রাহমান লোমাক যেমন বলেছেন, এই “ডিম” ব্যাখ্যা আবার “nonsense” (আজগুবি) এই কারণে, যে ডিমের আকার আসলে পৃথিবীর ঠিক উলটা— ডিমের আকার হল দু’প্রান্তে সম্প্রসারিত গোলাকার (prolate spheroid), কিন্তু পৃথিবী দু’প্রান্তে চ্যাপ্টা গোলাকার (oblate spheroid)।
পৃথিবীর আকার নিয়ে আরও কিছু কোরআনের আয়াত এখানে দেওয়া হলো—
“আর পৃথিবী, উহাকে আমি বিস্তৃত করিয়াছি…” (সূরা হিজর ১৫:১৯)
“আমি কি করি নাই ভূমিকে শয্যা ও পর্বতসমূহে কীলক?” (আল-নাবা ৭:৯৬)
“উহারা কি উহাদের উর্ধ্বস্থিত আকাশের দিকে তাকাইয়া দেখে না আমি কিভাবে উহা নির্মাণ করিয়াছি ও উহাকে সুশোভিত করিয়াছি এবং উহাতে কোন ফাটলও নাই। আমি বিস্তৃত করিয়াছি ভূমিকে ও তাহাতে স্থাপন করিয়াছি পর্বতমালা…” (সূরা কাফ্ ৫০:৬,৭)
“এবং আকাশের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, তা কিভাবে উচ্চ করা হয়েছে? এবং পাহাড়ের দিকে যে, তা কিভাবে স্থাপন করা হয়েছে? এবং পৃথিবীর দিকে যে, তা কিভাবে সমতল বিছানো হয়েছে?” (সূরা গাশিয়াঃ ৮৮:১৮-২০)২২
খ্যাতিমান সুন্নি তফসীরে আল-জালালাইন এই আয়াতের তাফসীর করে বলেন—
“উনার سُطِحَتْ (সুতিহাৎ) শব্দটির অর্থ “সমতল হয়ে বিস্তৃত করা” অনুযায়ী আক্ষরিক অর্থে বুঝানো হয়েছে যে পৃথিবী সমতল, যেটা শরীয়তের অধিকাংশ আলেমদেরই মতামত কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গোলাকার ধারণার বিপরীত।”
একই ভাবে মিসরীয় শাফি’ঈ ধর্মতত্ত্ববিদ ঈমাম আল-সুয়ুতি শিক্ষা দিতেন যে পৃথিবী সমতল।
উপরোক্ত সমস্ত জটিল আয়াতগুলো থাকা সত্যেও, নায়েক বাইবেলকে আক্রমন করে দাবী করেন যে দানিয়েল ৪:১০-১২ অনুযায়ী বাইবেল বলেন যে পৃথিবী সমতল—
“বিছানায় শুয়ে আমি এই দর্শন দেখেছিলাম। আমি তাকিয়ে দেখলাম একটা গাছ … দুনিয়ার শেষ সীমা থেকেও গাছটা দেখা যাচ্ছিল … সমস্ত প্রাণীই তা থেকে খাবার পেত।” (দানিয়াল ৪:১০-১২)
এই অনুচ্ছেদ যে শুধু একজন অবিশ্বাসী রাজার দর্শনের বর্ণনার উদ্ধৃতি দেওয়া আছে (বাস্তবের বর্ণনা নয়), তা জাকির নায়েক পুরোপুরি অবহেলা করেন (অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়ে রাখেন)। অবশ্যই রাজা বখতে-নাসার হয়ত মনে করতেন যে পৃথিবী সমতল। স্বপ্নে যেমন করে প্রায়ই হয়, তাঁর স্বপ্ন হয়ত বাস্তবতাকে বিকৃত করেছে, অথবা তিনি তার স্বপ্নের বর্ণনা বুঝতে ভুল করেছিলেন। যেকোনো ক্ষেত্রে, এই আয়াত দিয়ে কোনভাবেই বলা যায় না যে কিতাবুল মোকাদ্দস পৃথিবীকে সমতল বলে।
নায়েক কিতাবুল মোকাদ্দসের আরেকটা দর্শন ব্যবহার করেন, যেখানে ইবলিস ঈসাকে প্রলোভনে ফেলার চেষ্টা করেছিল—
“এর পরে ইবলিস তাঁকে একটা উঁচু জায়গায় নিয়ে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যে দুনিয়ার সব রাজ্যগুলো দেখিয়ে বলল, “এই সবের অধিকার ও সেগুলোর জাঁকজমক আমি তোমাকে দেব, কারণ এই সব আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমার যাকে ইচ্ছা আমি তাকেই তা দিতে পারি।” (লূক ৪:৫)
নায়েকের কথা অনুযায়ী, এই আয়াত বুঝায় যে পৃথিবী সমতল। আসলে ইবলিসের এই দর্শন ছিল একটি অলৌকিক তাৎক্ষনিক দর্শন, যেমন করে নবীজীর মিরাজে যাত্রা এক অলৌকিক দর্শন হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হয়।
শেষে, নায়েক নিচের আয়াতটি ব্যবহার করেন “প্রমান” হিসেবে, যে বাইবেল পৃথিবীকে সমতল বলে—
“তিনি জাতিদের জন্য একটা নিশান তুলবেন আর বিদেশে বন্দী থাকা বনি-ইসরাইলদের জমায়েত করবেন; এহুদার ছড়িয়ে থাকা লোকদের তিনি দুনিয়ার চারদিক থেকে একত্র করবেন।”
নায়েকের কথা অনুযায়ী, এখানে বাইবেল বলছে যে দুনিয়ার চার কোনা আছে, অর্থাৎ সমতল। কিন্তু এই আয়াতের মূল হিব্রু শব্দ כּנף (কানাফ্) আক্ষরিক চারটি কোনা বোঝায় না, বরং বোঝাচ্ছে শুধু বিভিন্ন দিক থেকে। প্রাচীন ভুল বিশ্বতাত্ত্বিক ধারণা অনুযায়ী আবার পৃথিবী চারকোনা নয় বরং থালার মতো গোলাকার, তাই নায়েকের আক্ষরিক ব্যাখ্যা মানলেও বাইবেলের এই আয়াত প্রাচীন ভুলধারণার সংগে মিলে না। প্রাচীন সভ্যতাগুলো কিন্তু চারটি প্রধান দিক (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম) ভালোভাবে বুঝতেন, যার কারণে আমরা অবশ্যই כּנף (‘দিক’) শব্দটাকে সেইভাবে ব্যাখ্যা করব। বাইবেলের সমালোচক আহমেদ দিদাত (নায়েকের উস্তাদ) নিজেই এই রকম ভাষা ব্যবহার করেছেন, “to the four corners of the globe” (“পৃথিবীর চারটি কোনা পর্যন্ত”)!২৩
এইভাবে আমরা দেখি যে, নায়েকের অক্লান্ত প্রচেষ্টার পরেও, কিতাবুল মোকাদ্দসে পৃথিবীকে সমতল বলে না, বরং যেহেতু প্রাচীন হিব্রু ভাষায় “গোলক” (তিন ডাইমেনশনের গোল বস্তু) বলে কোন শব্দ ছিল না, সেহেতু কিতাবুল মোকাদ্দসে পৃথিবীকে “চক্র”-ই বলে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে “চক্র” কথাটি কিতাবুল মোকাদ্দসে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে (দেখুন ইশাইয়া ৪০:২২, আইয়ুব ২৬:১০, মেসাল ৮:২৭)।
আসমানকে ধরে থাকা স্তম্ভ
কোরআন আসমানের স্তম্ভের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না, বরং কোরআন এই স্তম্ভগুলোকে বলে অদৃশ্য—
“আল্লাহ্ই উর্ধ্বদেশে আকাশমণ্ডলী স্থাপন করিয়াছেন দৃশ্যমান স্তম্ভ ব্যতীত।”
(সূরা রা’দ ১৩:২, লুকমান ৩১:১০)
এই আয়াত বিভিন্নভাবে অনুবাদ হয়, কিন্তু ইবনে কাথির তফসীরে এই আয়াত সম্পর্কে বলেন—
“ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, আল-হাসান, কাতাদাহ এবং আরও অনেক আলেমদের মতে স্তম্ভ আছে কিন্তু আমরা সেগুলোকে দেখতে পাই না”
কোরআনের আয়াতের মতো বাইবেলেও একটি আয়াত আছে যেখানে স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে, আর এই আয়াতের বর্ণনা অনেক সমালোচকই ভুলভাবে বাইবেলের বিশ্বতত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার করেন—
“আকাশের থামগুলো কেঁপে ওঠে, তাঁর বকুনিতে সেগুলো চম্কে ওঠে।” (আইয়ুব ২৬:১১)
আইয়ুব নবীর এই কিতাব হল কাব্যিক হিকমত সাহিত্যিক ধরনের লেখা, যার কারণে এর মধ্যে ব্যাপক রূপক ও উপমাময় চিত্রকল্প ও কাব্যিক ভাষা রয়েছে। আমরা এই-ই জানি যে, আইয়ুব আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করতেন না যে আকাশের থাম ছিল, কারণ আগের একটি আয়াতে তিনি বলেছেন—
তিনি শূন্যে উত্তরের আসমান বিছিয়ে দিয়েছেন;
শূন্যের মধ্যে দুনিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। (আইয়ুব ২৬:৭)
এই আয়াত অনুযায়ী, আইয়ুব নবী জানতেন যে আকাশ শূন্যের উপর ভাসমান, আর এটাও জানতে যে সমগ্র পৃথিবীটাই শূন্যের উপর ভাসমান, যেটা আইয়ুবের সময়কাল ধারণার তুলনায় খুব আধুনিক একটি ধারণা। সমালোচক যদি এসব প্রমান গ্রহণ না করেন, তবে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিৎ যে এই কিতাবের শেষে আল্লাহ্পাক আইয়ুবকে ধমক দেয় কারণ সৃষ্টিজগতের বিষয়ে আইয়ুবের সীমিত জ্ঞান আল্লাহ্র অসীম জ্ঞানের তুলনায় খুবই দুর্বল (আইয়ুব ৩৮.১-৪)। শেষে আইয়ুব তওবা করে এবং আল্লাহ্ তাঁকে পুরস্কৃত করেন।
দুনিয়ার নিচে থাম
নায়েক বাইবেলকে আক্রমন করে বলেন যে বাইবেল অনুযায়ী পৃথিবীর স্তম্ভ রয়েছে—
“তিনি দুনিয়াকে তার জায়গা থেকে নাড়া দেন,
তার থামগুলোকে কাঁপিয়ে তোলেন।” (আইয়ুব ৯:৬)
দুনিয়া ও তার মানব-সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা যখন ভেংগে যায়,
তখন আমিই তার থামগুলো টিকিয়ে রাখি।” (জবুর শরীফ ৭৫:৩)
এই বর্ণনার কোন সমস্যা নাই, কারণ এই আয়াতগুলোর মূল হিব্রু ভাষার “দুনিয়া” ও “থাম” হল প্রাচীন ভাষায় যা আজকাল স্পষ্ট পরিভাষায় আমরা বলি “মহাদেশীয় প্লেটগুলো” ও “ভূগর্ভস্থ স্তর”।২৪ আল্লাহ্তা’লা প্রাচীন মনুষ্য ভাষা ব্যবহার করে সেকালের কথা, উপমা ও বাক্যালংকার ব্যবহার করেছেন – তিনি যদি সেকালের মানুষদেরকে বলতেন, “…তখন আমি মহাদেশীয় প্লেটগুলোর ভূগর্ভস্থ স্তরগুলো টিকিয়ে রাখি,” কেহ বুঝত না। একই ভাবে কোরআন শরীফেও বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার হয় না বরং প্রাচীন চলতি ভাষা। মূল কথায়, এই আয়াতের উদ্দেশ্য হল মনুষ্য ভাষায় আল্লাহ্তা’লার সার্বভৌমত্ব বোঝানো, প্রকৃতির তথ্য বোঝানো নয়।
নায়েক নিম্ন আয়াতও ব্যবহার করেন—
তিনি গরীবকে ধুলার মধ্য থেকে তোলেন,
আর অভাবীকে তোলেন ছাইয়ের গাদা থেকে।
উঁচু পদের লোকদের সংগে তিনি তাদের বসতে দেন,
আর দেন সম্মানের সিংহাসন;
কারণ দুনিয়ার থামগুলো মাবুদেরই,
তিনি সেগুলোর উপরে জমীনকে স্থাপন করেছেন। (১ শামুয়েল ২:৮)
এই আয়াতে “থাম” এর মূল হিব্রু শব্দ হলো মাৎসুক, যার আরেক অর্থ “ভিত্তি”। আবার, “থাম” হলো মহাদেশীয় প্লেটগুলোর নিচে ভূগর্ভস্থ স্তরের একটি উপযুক্ত বিবরণ। আমাদের এটাও মনে রাখা উচিৎ যে এই আয়াত হল ঐতিহাসিক বিবরণের মধ্যে কেবল এক ভ্রমপ্রবণ মহিলা (নবী শামুয়েলের মা হান্না)-এর মুনাজাতের উদ্ধৃতি।
সূর্য, চাঁদ, তারা, উল্কা ও আসমান
নায়েক অনুযায়ী, তৌরাত শফীফের পয়দায়েশ ১:১৬-১৮ বলেন চাঁদের নিজস্ব আলো আছে—
আল্লাহ্ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন। তিনি সেগুলোকে আসমানের মধ্যে স্থাপন করলেন যাতে সেগুলো দুনিয়ার উপর আলো দেয়, দিন ও রাতের উপর রাজত্ব করে আর অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে রাখে। আল্লাহ্ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। (পয়দায়েশ ১:১৬-১৮)
এই যুক্তি অতি দুর্বল, কারণ চাঁদকে “আলো” বলা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য, এবং এই আয়াতে কোথাও চাঁদকে ‘আলোর উৎস’ বলা হয় না। নায়েকের এই যুক্তি অনুযায়ী, “জ্যোৎস্না” বা moonlight বলাও ভূল, কারণ সেখানেও বোঝানো হয় যে চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। প্রকৃতির বর্ণনায় প্রত্যেক আসমানী কিতাব বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নয় বরং সাধারণ ভাষা ব্যবহার করেন—যেমন কোরআনও চাঁদকে “নূর” বলে (৭১:১৬)। পয়দায়েশে যে মূল হিব্রু “আলো” শব্দ আছে (מאור মা’ওর), সেটা শুধু নিজস্ব আলো বোঝায় না বরং প্রতিফলিত আলোও বোঝায় (যেমন মেসাল ১৫:৩০ আয়াতে এই শব্দের ব্যবহার দেখুন)। এমনকি, ইহিষ্কেল ৩২:৭-৮ ও মথি ২৪:২৯ আয়াতে ইঙ্গিত আছে যে চাঁদের আলো সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল।
কোরআনেও চাঁদ নিয়ে কিছু জটিল বর্ণনা আছে। কারণ লেখা আছে যে সাতটি আসমান স্তরে স্তরে আছে, এবং তারাগুলো সবচেয়ে নিম্ন স্তরে অবস্থিত২৫ (যদিও বিজ্ঞান বলে তারা বিশ্বের সবখানে আছে)। কিন্তু সূরা নূহ্ ৭১:১৫-১৬ আয়াত অনুযায়ী চাঁদের অবস্থান এই সপ্ত আকাশের মাঝখানে, অর্থাৎ তারা-স্তরের চেয়ে বেশী দূর পৃথিবী থেকে।
কোরআনে উল্কা নিয়ে আমরা আরো বিশ্বতাত্ত্বিক জটিলতা পাই। সূরা আস-সাফফাতে আছে—
নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্ধ্ব জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয় ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে। (আস-সাফফাত ৩৭:৬-১০)২৬
এই আয়াত অনুযায়ী মনে হচ্ছে, উল্কার উদ্দেশ্য হল বেহেশতে আড়ি পাতা জ্বীনদের বিতাড়নের জন্য। কোরআন শরীফের এই দুটি উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য কোরআনকে মোটেও আক্রমন করা নয়, বরং বোঝানোর জন্য যে জটিল বৈজ্ঞানিক বিবরণের কারণেই কিতাবে অস্বীকার করা যায় না।
বিজ্ঞানের ইতিহাস
জাকির নায়েকের মতো সমালোচক প্রায়ই চেষ্টা করেন এটা বুঝাতে যে বাইবেল বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে—
“If you analyze, the Church was against science previously – and you know the incident that they sentenced Galileo to death. They sentenced Galileo to death – why? Because he said certain statements in the astronomy, etcetera, which went against the Bible – so they sentenced him to death. [বিশ্লেষণে জানা যায়, চার্চ বিজ্ঞানের বিপক্ষে ছিল আগে— এবং আপনারা জানেন সেই ঘটনা যখন এরা গ্যালিলিওকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলেন। এরা গ্যালিলিওকে মৃত্যদণ্ডের রায় দিলেন— কেন? কারণ তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে, ইত্যাদি কিছু কথা বলেছেন যেটা বাইবেলের বর্ণনার বিপক্ষে—এইজন্য এরা তাকে ফাঁসির রায় দিলেন।] ২৭
গ্যালিলিওকে চার্চ কখনই মৃত্যুদণ্ড দেয়নি।১৬৩৩ সালের ২২শে জুন তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে শুধু গৃহবন্দী রাখা হয়। এরও অনেক পরে ১৬৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাসের দলীল এই সাক্ষ্য দেয় যে বাইবেল-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের অগ্রগতির অনেক উপকার এনেছেন। বারবার দেখা যায় যে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের প্রকৃতির গবেষণা করার প্রেরণা যুগিয়েছে বাইবেলের প্রতি এদের গভীর বিশ্বাস। বিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বিজ্ঞান শুধু “তথ্য আবিষ্কার” নয় বরং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গঠিত। যে সমাজে নদী, গাছকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়, তারা বিপজ্জনক বন্যা প্রতিরোধ করতে অথবা নদীর ক্ষমতা ব্যবহার করতে বাঁধ তৈরী করার উদ্যোগ নেয় না। যেমন গ্রীক সভ্যতা প্রযুক্তিতে বেশী অবদান রাখেনি কারণ এরা বস্তুগত জগত ও কর্মকে অবজ্ঞা করত।
স্যার আইজাক নিউটন (Sir Isaac Newton) (১৬৪৩–১৭২৭) একজন ধার্মিক খ্রীষ্টান ছিলেন এবং মনে করতেন যে তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো স্রষ্টার উপস্থিতিকেই প্রমাণ করে। বিজ্ঞানের চেয়ে খ্রীষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়েই বেশি লেখালেখি করেছেন নিউটন। তার জীবনকালে, দেকার্তের মতো দার্শনিকদের ধারণা ছিল যে প্রাকৃতিক জগৎ ও রূহানিক জগৎ দুটি খুব আলাদা এবং পৃথক। আবার কিছু দার্শনিকগণ মনে করতেন যে বস্তু জগতে একটা সর্বব্যাপি নৈর্ব্যক্তিক রূহানিকতা ছিল। কিন্তু নিউটন এই দুই পুরোপুরি যান্ত্রিক বস্তুবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী মতবাদ এড়িয়ে, তার বিখ্যাত সূত্রগুলো দাঁড় করেছেন বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গির উপরে। ইঞ্জিল শরীফ (নিউ টেস্টামেন্ট)-এর প্রতি নিউটনের দৃঢ বিশ্বাস ছিল, এদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তিনি যীশু খ্রিষ্টকে প্রভু হিসেবে অনুসরণ করতেন।
রবার্ট বয়েল (Robert Boyle) (১৬২৭-১৬৯১) আধুনিক রসায়নের স্থাপক ও গভীর বিশ্বাসী একজন খ্রীষ্টান, তিনি বয়েলের সূত্রের উদ্ভাবক– যে গ্যাসের চাপ তার আয়তনের সঙ্গে বিপরীতভাবে আনুপাতিক। তার জীবনকাল তিনি খ্রীষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন।
নিকলাস কপারনিকাস (Nicolaus Copernicus) (১৪৭৩-১৫৪৩) কপারনিকাসই প্রথম আধুনিক সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদ প্রদান করেন। যদিও এর পূর্বে সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ উপস্থাপন করেছেন কিছু গ্রীক, মুসলিম, ও ভারতীয় দার্শনিক, কপারনিকাস প্রথম এই তত্ত্বে একটি গাণিতিক মডেল সর্বসমক্ষে আনেন। কপারনিকাস একজন ক্যাথলিক যাজক ছিলেন, এবং তাঁর নতুন সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বগুলো তিনি প্রথম পোপ ক্লেমেন্ট ও কয়েকজন ক্যাথলিক কার্দিনালের কাছে প্রকাশ করেন, যারা তাকে উৎসাহিত করেন। কপারনিকাস ৭০ বছর বয়সে মারা যান এবং দাফন হন ফ্রমবর্ক ক্যাথিদ্রালে।
ইয়োহানেস কেপলার (Johannes Kepler) (১৫৭১-১৬৩০) কেপলার ১৭শ শতকের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদের সমর্থনে সর্বপ্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হিসেবে তিনি লেখেন Mysterium Cosmographicum (মহাবিশ্বের রহস্য)। অন্য কথায়, কেপলার প্রাচীন গ্রীক সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদটি প্রথম ফিরে আনেন ইউরোপে। এই গ্রন্থের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে একটি বিস্তারিত অধ্যায় আছে যেখানে বহু বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রমান করেন যে তার এই সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ হল বাইবেলের প্রকৃত শিক্ষা। কেপলার একজন গভীর ধার্মিক প্রটেস্টান্ট খ্রীষ্টান ছিলেন, যিনি যুববয়সে একজন খ্রীষ্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদ হতে চান। তার লেখালেখিগুলো প্রার্থনা, প্রশংসা ও ধর্মতাত্ত্বিক মন্তব্যে ভরা।
গ্যালিলিও গ্যালিলি (Galileo Galilei) (১৫৬৪-১৬৪২) আজীবনই একজন বিশ্বাসী ক্যাথলিক, গ্যালিলিও সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচার ও দুরবিনের (টেলিস্কপের) উন্নতির জন্য বিখ্যাত। অনেকেই ভুলবশত মনে করেন যে ক্যাথলিক চার্চের সমতল-পৃথিবীর ধারণার বিপরীতে যাওয়াতে গ্যালিলিওকে ফাঁসি করেছিলেন, কিন্তু আসলে মতের অমিল ঘটেছিল পৃথিবীর গতিপথ নিয়ে। গ্যালিলিওর সময়ের বিগত দু’হাজার বছর ধরে পৃথিবীর গোলাকার সুপরিচিত ছিল; ক্যাথলিক চার্চ সমতল-পৃথিবী ধারণাটি কখনো সমর্থন করেননি। ক্যাথলিক যাজকগণ বাইবেলে ভূকেন্দ্রিকতাবাদের সমর্থনে এমন আয়াত ব্যবহার করেছেন যেখানে বলা আছে যে সূর্য “ডুবে” যায় এবং “উঠে”, যেমন করে কোরআনে একই কথা লেখা আছে সূরা আল-কাহ্ফ ১৮:১৭ আয়াতে। আসলে গ্যালিলিও কখনো বলেননি যে বাইবেলের বর্ণনা ভুল, বরং তিনি একটি গ্রন্থ তর্ক করেছেন যে সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ বাইবেলে সমর্থিত, যেখানে তিনি অগস্টীনের মত কিছু প্রথম চার্চ ফাদার মন্তব্য বা তাফসীর ব্যবহার করেছেন। গ্যালিলিওর সঙ্গে ক্যাথলিক চার্চের এই বিতর্কের জন্য বাইবেলকে দোষী করা অসম্ভব, কারণ সেকালের ক্যাথলিক চার্চ বাইবেল নয় বরং তাদের নিজের জাতিগত প্রথাগুলোর উপর বেশী নির্ভরশীল ছিল।২৮ কেপলার, আরেকজন প্রথম সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদের পূর্ববাদী, একজন ধার্মিক খ্রীষ্টান হয়ে বাইবেলের যুক্তি দিয়ে সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ প্রচার করতেন।
ইসলামের ইতিহাসেও এই রকম সংঘাত দেখা দিয়েছিল। ১২ শতাব্দীর আরবীয় বিজ্ঞানী ইবনে আল হাইতাম দাবী করেন যে পৃথিবী সমতল নয় বরং গোলাকার, যার কারণে শহরের ঈমামগণ বললেন যে তার লেখা কোরআনের শিক্ষার বিপরীত। তাকে ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষণা করা হয় এবং তার জ্যোতিবিদ্যার নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়, এবং কয়েক শত বছর ধরে তার অবদানগুলো অবহেলা করা হয় কারণ তার গোলাকার-পৃথিবী ধারণা মনে করা হত অধার্মিক এবং নাস্তিকতার একটি প্রতীক।২৯
কার্ল লিনিয়াস (Carl Linnaeus) (১৭০৭-১৭৭৮) প্রখ্যাত সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও প্রাণীবিজ্ঞানী যিনি আধুনিক দ্বিপদী নামকরণের ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন। তাকে আধুনিক শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যার জনক বলা হয়। এছাড়া তিনি আধুনিক পরিবেশবিজ্ঞানের জনকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে রুসো বলেন, “দুনিয়াতে আমি তাঁর চেয়ে মহৎ লোক চিনি না,” এবং তার জীবনকালে তাকে মনে করা হত ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। লিনিয়াস একজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিলেন, তার জীবনের আদর্শবাণী বা মূলমন্ত্র ছিল-“সততায় চল কারণ আল্লাহ্ উপস্থিত।” তিনি উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যাতে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির রহস্যকে উদ্ঘাটন করে তিনি আল্লাহ্র গৌরব প্রকাশ করাই মনে করতেন। নিঃসন্দেহে তিনি বাইবেলে বর্ণীত সোলায়মানের জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন—
তিনি [বাদশাহ্ সোলায়মান] লেবাননের এরস গাছ থেকে শুরু করে দেয়ালের গায়ে গজানো হিস্যোপ গাছ পর্যন্ত সমস্ত গাছের বর্ণনা করেছেন। তিনি জীব-জন্তু, পাখী, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও মাছেরও বর্ণনা করেছেন। দুনিয়ার যে সব বাদশাহ্রা সোলায়মানের জ্ঞানের বিষয় শুনেছিলেন তাঁরা তাঁর জ্ঞানপূর্ণ কথা শুনবার জন্য লোকদের পাঠিয়ে দিতেন। এইভাবে সমস্ত জাতির লোক তাঁর কাছে আসত।
(১ বাদশাহ্নামা ৪:৩৩-৩৪)
একইভাবে, সেই সময়ে ইউরোপের প্রায় সব প্রকৃতিবিজ্ঞানীরাই ধর্মযাজক ছিলেন যারা তাদের শখের বশে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করতেন। বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী জন রে (John Ray) (১৬২৭-১৭০৫৬) তৌরাত শরীফের সৃষ্টি বিবরণের উপর ভিত্তি করেই সর্বপ্রথম প্রজাতির আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন।
একজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজক, বিখ্যাত বেলজীয় বিশ্বতত্ত্ববিদ জর্জ ল্যমেত্র্ (Georges Édouard Lemaître) (১৮৯৪-১৯৬০) ১৯২৭ সালে সর্বপ্রথম মহা বিস্ফোরণ তত্ত্ব (“বিগ্ ব্যাংগ”) প্রস্তাব করেন। তিনি লেখেন, “আলো দিয়ে বিশ্ব শুরু হওয়ার কথা” (তৌরাতের বিবরণে যেমন)। বৈজ্ঞানিক মহলে এই বিশ্বতাত্ত্বিক ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার আগেও তার একজন আগ্রহী সমর্থক ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের নেতা পোপ পিয়ান ১২।
ফরাসী বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল (Blaise Pascal) (১৬২৩-১৬৬২) একজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিলেন যিনি তার সমস্ত বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক গবেষণার শেষে খ্রীষ্টধর্মের সমর্থনে একটি বিখ্যাত রচনা লেখেন Pensées।
বিখ্যাত খ্রীষ্টান বৈজ্ঞানিকদের তালিকা অশেষ: রজার বেকন (Roger Bacon), ফ্যারাডে (Faraday), হার্শেল (Herschel), জে.সি. অ্যাডাম্স J.C. Adams, ভন্ হেল্মন্ট (van Helmont), হাইজেনবের্গ (Heisenberg), প্লাংক (Planck), হাইগেনস (Huygens)। বাইবেল কোনমতেই বিজ্ঞানের বাধা দেয় না, বরং তা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেয় যা প্রকৃতির অনুসন্ধান ও পরীক্ষণ করবার প্রেরণা যোগায়। ইতিহাসের দলীল এই সততার প্রমাণ করে যে, কিতাবুল মোকাদ্দস অনুপ্রাণিত করেছে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বগণকে।
বিজ্ঞানের “উদ্ভাবক” কে?
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ইসলামি বিশ্বের এক সময় স্বর্ণযুগ ছিল যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় বিজ্ঞানের বিপ্লব ঘটতে সাহায্য করে। অষ্টম শতক থেকে শুরু করে ১৩ শতক পর্যন্ত, ইসলামিক সাম্রাজ্য বিশ্বের প্রধান জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গ্রীস, চীন ও ভারত থেকে আসা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার চর্চা শুরু হয় এবং এগুলোর উন্নতিও সাধন হয় এই যুগে। ইবনে-সিনা, ইবনে-রুশদ, আল-ফারাবি, ইবনে আল-হাইসাম, আল-খৈয়াম, আল-কিন্দি এবং আল-রাজির মতো বিখ্যাত পন্ডিতগণ আলোকবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপীয় মহাজাগরণের (রেঁনেসা) জন্য রাস্তা প্রস্তুত করেন। এই ইসলামি স্বর্ণযুগে মুসলিম, খ্রীষ্টান এবং খ্রীষ্টান পন্ডিতগণ পাশাপাশি কাজ করে বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য আরবী ও পারস্য ভাষায় অনুবাদ করেন এবং বাগদাদ, করদোবা এবং কায়রোর মতো শহর পান্ডিত্বের পাঠশালায় পরিণত হয়। সেকালের পন্ডিতগণ এরিস্টটল, ইউক্লিড, প্ল্যাটো এবং ভারতীয় ও চীনা দার্শনিকগণদের বিভিন্ন কাজ নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণা শুরু করেন। ইউরোপীয় পুনরুজ্জীবন ভিত্তি হয়েছিল আরবী সাম্রাজ্য থেকে ফিরে পাওয়া প্রাচীন গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞানের উপরে, এবং তার সাথে ইবনে সিনা এবং ইবনে-রুশদের মতো আরবী পন্ডিতগণের লেখাগুলোও বেশ প্রভাবশালী ছিল।
আজকাল যেমন কিছু হিন্দু মৌলবাদী দাবি করেন যে জ্ঞানবিজ্ঞানের সব কিছুরই উৎপত্তি ভারতে, তেমনইভাবে কিছু মুসলিম প্রচারকগণও দাবি করেন যে বিজ্ঞানের সব উল্লেখযোগ্য অবদানগুলো ইসলাম থেকেই এসেছে। বাস্তবে, ইসলামের সেই স্বর্ণযুগ বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, ঠিক যেমনটি করে গ্রীক, মিশরীয়, ভারত, চীন, রোম, ইউরোপ এবং শেষে বর্তমান বিশ্বও বিজ্ঞানের এই ধারায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিজ্ঞান এক সভ্যতা বা ধর্মের অবদান বলে দাবি করা কেবল বোকামি। ‘ইসলামি বিজ্ঞান’ সম্পর্কে সর্বপ্রথম মুসলিম নোবেল-পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম বলেন:
“There is only one universal science; its problems and modalities are international and there is no such thing as Islamic science just as there is no Hindu science, nor Jewish science, no Confucian Science, nor Christian Science.” [শুধুমাত্র একটাই বিশ্বজনীন বিজ্ঞান আছে; এর সমস্যা ও ধরণগুলো আন্তর্জাতিক এবং ‘ইসলামি বিজ্ঞান’ বলে কিছু নেই যেমন করে হিন্দু বিজ্ঞান, ইহুদি বিজ্ঞা, কনফুশীয় অথবা খ্রীষ্টীয় বিজ্ঞান বলে কিছু নেই।”]
জাকির নায়েকের মতো টেলিভিশন প্রচারকগণ ইসলামের অবদান বলে দাবি করেছেন বিশ্ব-মানচিত্র থেকে শুরু করে সাবান, কফি থেকে শূন্য সংখ্যা সবই। শুন্য সংখ্যাটা এই বিভ্রান্তিকর দাবির একটি ভালো উদাহরণ। আরবগণ এই শূন্য ধারণাটি ইউরোপে উপস্থাপন করেছেন বলে ইউরোপে এই শূন্য-সম্পন্ন সংখ্যার পদ্ধতিকে বলা হয় ‘Arabic Numerals’। কিন্তু আরবগণ এই শূন্য ধারণাটা পেয়েছেন ভারত থেকে। আরব দুনিয়া ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ব্রাহ্মগুপ্তের “ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত” ৬২৮ শালে লিখিত গ্রন্থের মাধ্যমে। আনুমানিক ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কঙ্ক নামে এক পণ্ডিত বাগদাদে আল ফাজারির সাহায্যে এই গ্রন্থের আরবি ভাষা অনুবাদ করেন, এবং আল-খোয়ারিজমি ও আল-কিন্দি এই ভারতীয় ধারনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সাধন করেছেন মাত্র।
একইভাবে Algebra (বীজগণিত) আরবীয় শব্দ ‘আল-জব্র’ (الجبر) থেকে নেওয়া হয়েছে কারণ খোয়ারিজমির বই দ্বারা বীজগণিত ইউরোপে আসলো, কিন্তু বীজগণিতের উৎপত্তি আরবদের মধ্যে নয় বরং ব্যাবিলোনীয় সভ্যতার মধ্যে। কিছু লোক যেমন দাবি করেন, ত্রিকোণমিতি (Trigonometry) এর উদ্ভাবক আরবীয় গণিতবিদ ওমর খৈয়াম নয়, বরং গণিতের এই শাখার উৎপত্তি ৪,০০০ বছর আগে। অ্যালগোরিদম প্রথম ব্যবহার করেছেন প্রাচীন ব্যাবলনীয়রা, ইউক্লিড, এবং এরাতসথেনেস, এবং পরে আল-কিন্দি এর উন্নতি সাধন করেন।
টেলিভিশন প্রচারক জাকির নায়েক দাবি করেছেন যে, “…the first people who drew the world map were the Muslims” (… সর্বপ্রথম বিশ্বমানচিত্র এঁকেছেন মুসলমানরা”]। মনে হয় নায়েক কখনও টলেমির কথা শুনেনি, যে গ্রীক পন্ডিত ইসলামের পাঁচশত বছর আগে প্রথম বিশ্বমানচিত্র আঁকেন। নায়েক সম্ভবত পিরি রেইসের ১৫১৩ সালের বিশ্বমানচিত্রের কথা বলতেছেন, যেটা আধুনিক মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিতে মাত্র একটা ছোট ধাপ বলা যায়।
বলা হয়েছে যে জাবির ইবন হাইয়ান পাতন পদ্ধতি ‘আবিষ্কার’ করেন ৮০০ সালে, কিন্তু আসলে এরিস্টটল এই পদ্ধতির উল্লেখ করেন এবং প্লাইনি (Pliny the Elder, মৃত্যু ৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) একটি প্রাচীন পাতনযন্ত্র (যে যন্ত্র দিয়ে পাতন করা হয়) এর কথা বলেছেন। আবার তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে ইহুদী ভদ্রমহিলা মারিয়া (Maria the Jewess) আধুনিক অ্যালকোহল পাতনযন্ত্রের একটি পূর্বলক্ষণ বানিয়েছেন, এবং অ্যালকোহল তৈরি করার উদ্দেশ্যে মিসরীয়রা তৃতীয় শতাব্দীতে পাতন ব্যবহার করতেন। জাবির যা করেছেন তা হল একটি অ্যালেম্বিক (“আল-ইন্বিক”) স্টিল – তিনি পাতন পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেননি। পৃথিবী গোল আকার আরব পন্ডিতেরা আবিষ্কার করেননি বরং প্রাচীন গ্রীকেরা। এরিস্টটল এই তত্ত্বের প্রমান করেন খ্রীষ্টপূর্বাব্দ চতুর্থ শতাব্দীতে। পৃথিবীর পরিধির মাপ হিসাব করে এরাটোস্থেনেস্ মাত্র শতকরা এক ভাগ ভুল হল—২৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আধুনিক যুগের আগে যে সবাই সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাসী ছিলেন, তা একটা কাল্পনিক কাহিনী। প্রথম শতাব্দীর মধ্যে প্লাইনি (Pliny) বলেন যে প্রায় সবাই একমত যে পৃথিবী গোলাকার।৩০
বারুদ – ইংল্যান্ডে একটি মুসলিম ভ্রমণ যাদুঘর দাবি করেন—
Though the Chinese invented saltpetre gunpowder, and used it in their fireworks, it was the Arabs who worked out that it could be purified using potassium nitrate for military use. [চীনে সল্টপেট্রে (অর্থাৎ শোরা) রারুদ আবিষ্কার হয়েছে এবং আতশবাজিতে এরা তা ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু আরবগণই আবিষ্কার করেন যে সেটা পটাশিয়ম নাইট্রেট দিয়ে পরিষ্কার করা যায় সামরিক ব্যবহারের জন্য।]
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সল্টপেট্রে আর পটাশিয়াম নাইট্রেট একই জিনিস! হয়ত আরবরা আরো পরিষ্কার শোরা তৈরী করেছেন। বারুদ আবিস্কার হয়েছে চীনে সপ্তম শতাব্দীতে এবং মঙ্গোল অথবা সিল্ক রোড দ্বারা সেটা পশ্চিমে আসেন। যাই হোক, চীনরা সবার আগেই সামরিক রকেট ব্যবহার করতেন ১১শ শতাব্দীতে— অন্য সব সভ্যতার অনেক আগে। প্রচারকগণ দাবি করেন যে আব্বাস ইবন ফির্নাস ৮৭৫ সালে একটি মোটামোটি সফল ইঞ্জিনবিহীন বিমান বানাতে তিনি সর্বপ্রথম উড়াল আবিষ্কার করেন। কিন্তু ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকেই চীনে ইঞ্জিনবিহীন বিমানের ব্যবহারের বর্ণনা লিখিত আছে এবং ২১ শতাব্দীর আগে এদের ব্যবহারিক প্যারাশুট ছিল। সর্বপ্রথম ব্যবহারিক উড়োজাহাজ এখনও বলতে হবে গত শতাব্দীর রাইট ভাইদের আবিষ্কার।
তেমনইভাবে গালিচা, ব্যাংকের চেক, এবং বাতচক্র ইসলামের পূর্বে পারস্যে এবং মধ্য এশিয়াতে ছিল। শোনা যায় যে সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে বাগান আবিষ্কার করেন আরবরা, কিন্তু সেটা অবহেলা করে যে হাজার বছর আগেও ব্যাবিলনের বিখ্যাত ঝুলন্ত বাগান এবং গ্রীক ও রোমীয়দের বাগানগুলো। কফি জনপ্রিয় করেছেন আব্বাসীয় সাম্রাজ্য বটে, কিন্তু সেটা এরা পেয়েছে ইথিওপিয়া থেকে, যেখানে আদিবাসীরা কফি বীজ চিবিয়ে খেতেন শিকার যাত্রায় সজাগ থাকার জন্য।
শেষে আবারও বলতে হবে যে ইসলামের স্বর্ণযুগ মানব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে, কিন্তু সেটা অন্যান্য সভ্যতার জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং অন্যান্য সভ্যতাকেও তেমনভাবে জ্ঞান যুগিয়েছে।
কেন এই স্বর্ণযুগের অবসান ঘটলো?
ইসলামী ইতিহাস পড়লে, গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সিদ্ধিলাভের একটি মহৎ সম্পত্তি। কিন্তু এসব সিদ্ধিলাভ (ইসলামী ইতিহাসের প্রথম কয়েক শতকে) হল ইসলামী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে মুক্তমনার সময়ে যখন গ্রীক ও ভারতীয় সভ্যতার সহযোগিতায় এরা কাজ করতেন। এই যুগে মুসলিম পন্ডিতগণ অন্য সভ্যতার সাহিত্য, দর্শন ও জ্ঞানের প্রতি খুব কৌতুহলী ছিল, এবং এগুলো পড়ে ও অনুবাদ করে এরা অন্য সভ্যতার পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। ইসলামী ইতিহাসে সবচেয়ে মহৎ পন্ডিতগণ যেমন ইবন সিনা ও ইবন রুশদ অন্য সভ্যতার সংস্কৃতির প্রতি খুব কৌতুহলী ছিলেন, এবং এই কারণে ইমাম-উলেমা সম্প্রদায় তাদেরকে ধর্মদ্রোহী বলে দোষী করেন।৩১ আল-হাইসমের রচনাবলী ইমাম সম্প্রদায় পুড়িয়ে দিল সেগুলোর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য, এবং ইবন রুশদের তার অগতানুগতিক অমুসলিম দর্শন গ্রহণের কারণে তাকে নির্বাসিত করা হল। [প্রসঙ্গক্রমে, ইসলামী স্বর্ণযুগের বিশিষ্ট কোরআন তাফসীরকারীগণ যেমন তাবারী, কুনুবী, ইবনে তামিজা এবং কুতুব পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর প্রতি খুব সম্মান দেখাত। তারা বলতেন যে কোরআন শরীফ তৌরাত ও ইঞ্জিলের বর্তমান নির্ভুল অস্তিত্ব স্বীকার করে, এবং ইঞ্জিলের কথা অনুযায়ী ঈসাকে ক্রুশে মেরে ফেলা হতেও পারে।]
“জাহিলিয়াত” এর প্রতি বিরোধিতা
ইমাম আল-গাজ্জালী সে স্বর্ণযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পন্ডিতগণের বিরুদ্ধে একটি জ্বালাকর সমালোচনা লেখেন যে কোরআনের চেয়ে এরা “অমুসলিম” গ্রীক লেখাগুলো নিয়ে বেশী আগ্রহী ও কৌতুহলী ছিলেন। শেষে গাজ্জালীর পক্ষে জয়ী হয়ে ইমামগণ বাইরের সভ্যতার বিদ্যাকে “জাহিলিয়া” অজ্ঞতা ও প্রলোভন বলে বাদ দিয়ে ঘোষণা করে “খাঁটি” মুসলিম বিষয় ছাড়া যেন পড়ানো না হয়। ইমাম গাজ্জালী গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যাকে বলেন ফার্দ-এ-কেফায়া ৩২ এবং সুস্পষ্টভাবে তিনি এগুলো ধর্মীয় এলেমের পিছনে দ্বিতীয় স্থানে রাখেন। আমরা গাজ্জালীর এই মনোভাব আজকালেও দেখি জাকির নায়েকের মতো বুকাইলিবাদ কট্টরপন্থীদের রূপে, যারা শুধুমাত্র কোরআনে ও ইসলামী ইতিহাসের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজে বেড়ান এবং অন্য ধর্মাবলম্বী ও সভ্যতাদের প্রতি বিরোধিতা দেখান।
হাস্যকর ব্যাপার হলো জাকির নায়েক ইসলামের স্বর্ণযুগ নিয়ে বেশী গর্ব করেন কিন্তু তাঁর সেই সঙ্কীর্ণচিত্ত মনোভাবই ইসলামের স্বর্ণযুগের পরিসমাপ্তি ঘটাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বাইরের বিদ্যা-জ্ঞানের প্রতি মধ্যযুগী ইসলামের এই সঙ্কীর্ণ মনোভাবে একটি উদাহরণ পাওয়া যায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রতি মধ্যযুগী ইসলামের প্রতিক্রিয়াতে।
মুদ্রণযন্ত্রের বিরোধীতা
মুদ্রণযন্ত্রের উদ্ভাবন ইউরোপে নয় বরং চীনে হয়েছিল কিন্তু চীনে এই যন্ত্র তেমন বেশী ব্যবহার হয়নি। ইয়োহানেস গুটেনবের্গ যখন “বিচল হরফ” (movable type) প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন এবং আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে তার সর্বপ্রথম বই মুদ্রিত হয় (বাইবেল), তখন তিনি এক সাক্ষরতা, শিক্ষা, তথ্য আদান প্রদানে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সূচনা করেন। এই উদ্ভাবনে গুটেনবের্গ তার উদ্দেশ্য ও প্রেরণা প্রকাশ করেছেন এইভাবে—
“ধর্মীয় শিক্ষা অল্পসংখ্যক ছোট পান্ডুলিপিতে বন্দী আছে যেগুলো জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করেন কিন্তু সেগুলো বিস্তার করেন না। আসুন আমরা এই পবিত্র জিনিসের বাঁধা সীলমোহর ভেঙ্গে; আমরা সেগুলোর সত্যকে পাখা দিই যেন সেটা কালামের সঙ্গে উড়ে, আর অনেক খরচে প্রস্তুত করা নয় বরং কোটি কোটি অনুলিপি চিরদিন একটি অক্লান্ত যন্ত্র দিয়ে বের হোক যেটা প্রত্যেক প্রাণকে জীবন দিতে সক্ষম।”
“সেটা একটি মুদ্রণযন্ত্র অবশ্যই বটে, কিন্তু এমন একটি মুদ্রণযন্ত্র যার দ্বারা অক্লান্ত স্রোত বয়ে যাবে… এই যন্ত্রের মাধ্যমে, ঈশ্বর তার বাক্য ছড়িয়ে দেবেন। তা থেকে একটি সত্যের ঝর্না বয়ে যাবে: একটি নতুন তারার মত সেটা অজ্ঞতার অন্ধকার হঠাবে, এবং একটি নতুন আলো মানব জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেবে।”
গুটেনবার্গের প্রত্যাশা সফল হয় যখন জনগণ অল্প খরচে মাতৃভাষায় কিতাব পেয়ে একটি ধর্মীয় পুনঃজাগরণ ঘটায়।
বাইবেল মুদ্রণযন্ত্রে প্রকাশ হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের ধর্মগ্রন্থ নিজ ভাষায় পৌছে যায় যেন তারা পড়ে বুঝতে পারে। এই ঘটনার সুবাদে সেই সময়ে সাধারণ মানুষদের জীবনে ধার্মিকতা,সততা ও কঠোর পরিশ্রমের এক ধর্মীয় পুনর্জাগরণ ঘটে যা পরে ১৮শ শতাব্দীর দিকে উত্তর ইউরোপে অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নতি ঘটায়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক ম্যাক্স ওয়েবারের কথা অনুযায়ী, উত্তর ইউরোপের সেই শিল্পবিপ্লবের পিছনে প্রটেস্টেন্ট চার্চদের শুরু করা বাইবেল শিক্ষার পুনর্জাগণই দায়ী।
ইউরোপে গুটেনবার্গের মূদ্রাযন্ত্র উদ্ভাবনের পরপরই ১৮৪৫ সালের দিকে ওট্টোমান সাম্রাজ্যের সুলতান বায়েজিদ ২ এই যন্ত্রের নিষিদ্ধ করেন। তার ফলে ৩৫০ বছরের মধ্যে আরবে আর কোন ছাপাখানা তৈরি হয়নি। সেই সময়ে যে কয়েকটি ছাপাখানা আরবের কাছাকাছি ছিল সেগুলোও খ্রীষ্টান ও ইহুদীরা চালাতো। আরব জগতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির বাধা হয়ে দাঁড়ালো সুলতান বায়েজিদের সেই সিদ্ধান্ত।
প্রকৃতির কিতাব ও ওহীর কিতাব
খ্রীষ্টানরা ও মুসলমানরা উভয়ই একই দু’টি জ্ঞানের উৎস গ্রহণ করেন— প্রকৃতির কিতাব (অর্থাৎ আল্লাহ্র দৃশ্যমান সৃষ্টি) এবং ওহীর কিতাব (আসমানি কিতাবগুলো)। অনেকসময় এগুলো আলাদা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যে ওহীর কিতাব ধর্মীয় রীতিনীতিও ধর্মবিশ্বাসের জগতে পরিচালনা দেয়, এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর প্রধানত “প্রকৃতির কিতাব” আমাদের পরিচালনা দেয় (ধর্মগ্রন্থ সবার উপরে স্থান পেয়ে থাকে)। তাহলে ধর্ম বৈজ্ঞানিক উন্নতির উপর কী প্রভাব ফেলে? তা হল এই— আমরা যে উপায়ে আমাদের নিজ ধর্মগ্রন্থগুলো জানার প্রতি স্বচেষ্ট হই তা পরবর্তীতে বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞানলাভের জন্য প্রভাব ফেলে। আমরা যেভাবে ধর্মগ্রন্থ পড়ি সেভাবেই আমরা বিজ্ঞান পড়ব।
এই সত্য ইতিহাসে আশ্চর্যভাবে দেখা যায়, যেখানে খ্রীষ্টধর্ম ও ইসলামধর্মের মধ্যে ধর্মগ্রন্থের ব্যবহারে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। ইসলামে, কোরআন শরীফ মূল ব্যবহার হয় মুখস্থ করে সঠিক উচ্চারণে আরবীতে আবৃত্তি করা, সাধারণ বইয়ের মত পড়ে জ্ঞানলাভ করা বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যাখ্যা করা নয়। ইজতেহাদ,অর্থাৎ ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা, বড় ধর্মীয় ব্যাপারে নিষেধ করা হল, এবং কিতাবের ব্যাখ্যা শুধু ধর্মযাজকদের ব্যাখ্যার মধ্যে আসল। এমনকি, ১২ শতকে যখন “ইজতেহাদের দরজা বন্ধ হল” তখনই ইসলামী স্বর্ণযুগটির পতন হল, যখন বলা হত যে ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার আর কোনো দরকার নেই। তাই প্রত্যেক ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি সাধারন মানুষকে প্যাকেট করে দেওয়া হল, এবং সাধারন মানুষের দায়িত্ব শুধু মুখস্থ ও আবৃত্তি করা, ধর্মীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা নয়। সরাসরি কিতাব থেকে নিজের ব্যাখ্যা নেওয়া হত না। এই মনোভাব, যে “আর বলার কিছু নেই”, প্রকৃতিক পড়াশোনার ক্ষেত্রেও গেল, এবং অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয়ে গেল শুধুমাত্র প্রাচীন পণ্ডিতদের কথা “মুখস্থ ও আবৃত্তি” করা, ‘প্রকৃতির কিতাবে’ ব্যক্তিগত গবেষণা ও আবিষ্কার নয়।
ইউরোপেও খ্রীষ্টান ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের আগে ঠিক একই অবস্থা বিরাজমান ছিল। ধর্মযাজকরা ধর্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রন করতেন এবং খুবই কম মানুষ ব্যক্তিগতভাবে আসমানি কিতাবগুলো নিজের জন্যে ব্যাখ্যা করতেন, শুধু ধর্মযাজকদের কথা মেনে বিদেশী ভাষায় কিতাব আবৃত্তি করা। কিন্তু মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারে, সাধারন মানুষ স্বল্প খরচে নিজ ভাষায় কিতাব পড়তে শুরু করলেন, এবং ইউরোপে বাড়িতে বাড়িতে জনগণরা প্রত্যেক রাত পরিবারগতভাবে মাতৃভাষায় কিতাব পড়ত। ধর্ম আবার প্রাচীন ঈসায়ী জামাতের নমুনায় ফিরে আসলো, এবং মনে করা হত যে ব্যক্তিগতভাবে কিতাব ব্যাখ্যা করা হল প্রত্যেক মানুষের একটি পবিত্র দায়িত্ব। এই বিশ্বাস বলা হত “priesthood of all believers” বা প্রত্যেক ইমানদারের ইমামতি”। এই ধর্মীয় সংস্কারের সুবাদে ধর্মীয়নেতাদের অনেক ভুল অনুবাদের কথা বের হয়ে আসে। এই থেকেই নতুন বিষয়ে জানা এবং সত্য অনুসন্ধানী মানসিকতা সবার মধ্যে বিরাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে নিউটন,কেপলার বয়েলের মতো এইরকম মানসিকতা সম্পন্ন প্রটেষ্ট্যান্ট খ্রীষ্টানরা প্রাচীন গ্রীক বৈজ্ঞানিক নথিপত্রগুলো গবেষণা শুরু করেন যা পরে বিজ্ঞানের পুণর্জাগরণ ঘটায়।
- ডাঃ জাকির নায়েক, কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান: সামঞ্জস্যপূর্ণ না অসামঞ্জস্যপূর্ণ? Islamic Research Foundation, www.irf.net, p.9,10.
- মুহাম্মদ মোস্তফা বিজনৌরী সম্পাদিত, ইসলাম এর ‘আক্বলিয়াত, লাহোর : ইদারাহ্ ইসলামিয়াত, ১৯৯৪, ৪০৩-৪২১.
- Daniel Golden, Strange Bedfellows: Western Scholars Play Key Role in Touting `Science’ of the Quran. Wall Street Journal, Jan 23, 2002. pg. A.1.
- When Science Teaching Becomes A Subversive Activity By Pervez Hoodbhoy
- Taner Edis, “Quran-science”: Scientific miracles from the 7th century? (retrieved from http://www2.truman.edu/~edis/writings/articles/quran-science.html)
- Abu Ammar Yasir Qadhi, An Introduction to the Sciences of the Quran Footnote, p.282.
- Abdus Salam “Foreword”, in Hoodbhoy, Pervez Islam and Science: Religious Orthodoxy and the Battle for Rationality, 1991: ix
- Strange Bedfellows: Western Scholars Play Key Role in Touting `Science’ of the Quran Wall Street Journal, Jan 23, 2002.
- Strange Bedfellows: Western Scholars Play Key Role in Touting `Science’ of the Quran Wall Street Journal, Jan 23, 2002.
- ডাঃ জাকির নায়েক, কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান: সামঞ্জস্যপূর্ণ না অসামঞ্জস্যপূর্ণ? Islamic Research Foundation, www.irf.net, p.9,10.
- Aristotle, On the Generation of Animals, section 728a & 654b.
- মরিস বুকাইলি, বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান, রূপান্তর আখ্তার-উল্-আলম, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৩২৯.
- Strange Bedfellows: Western Scholars Play Key Role in Touting `Science’ of the Quran Wall Street Journal, Jan 23, 2002.
- উদাহরণস্বরূপ, পয়দায়েশ ৬:৩ এবং ১৯:১৪এতে ইয়মের অর্থ ‘দিন’ হতে পারে না বরং ‘সময়’কে বোঝায়।
- জবুর শরীফের এই অধ্যায় হযরত মূসাকে আরোপ করা হয়েছে, যিনি ঐশী প্রেরণায় তৌরাতের পয়দায়েশ সৃষ্টিবর্ণনাও লিখেছে রেখেছেন।
- এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, Hugh Ross, Creator and the Cosmos, (Navpress, 2001) হ্যূহ্ রস, যিনি এই দিন-যুগ ব্যাখ্যার অন্যতম সমর্থক, তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ.ডি প্রাপ্ত একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সাবেক ক্যাল-টেকের পোস্ট-ডক্তরাল গবেষক, এবং ভ্যানকুভার রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী ডাইরেক্টর অব অবসার্ভেশন্স।
- হ্যূহ্ রস লিখেন, “Prior to the Nicene Council, the early Church fathers wrote two thousand pages of commentary on the Genesis creation days, yet did not devote a word to disparaging each other’s viewpoints on the creation time scale. All these early scholars accepted that yom could mean “a long time period.” The majority explicitly taught that the Genesis creation days were extended time periods (something like a thousand years per yom). Not one Ante-Nicene Father explicitly endorsed the 24-hour interpretation.” [নাইসিয়া পরিষদের আগে, প্রথম চার্চ নেতাগণ পয়দায়েশের সৃষ্টির অনুচ্ছেদের বিষয়ে দু’হাজার পৃষ্ঠার তফসীর লিখেছেন, কিন্তু এক শব্দ দিয়েও এরা পরস্পরের সৃষ্টির সময় মতামত সমালোচনা করেন নি। এই সব শিক্ষার্থীগণ গ্রহণ করেছেন যে ‘ইয়ম’এর অর্থ হতে পারে “দীর্ঘকাল সময়।” এরা বেশির ভাগই সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষা দিতেন যে পয়দায়েশের সৃষ্টির দিনগুলো দীর্ঘ সময়ের মেয়াদ ছিল (যেমন প্রতি ইয়মে এক হাজার বছর)। নাইসিয়া পরিষদের আগে, একটাও নেতা সুনির্দিষ্টভাবে ২৪-ঘনটা ব্যাখ্যার সমর্থন দেন নি।] (The Genesis Debate, ed David Hagopian (Crux Press: Mission Viejo, 2001), p 125,126.
- হাদীস নং-৬৮৮৭, সহীহ্ মুসলিম শরীফ: সকল খণ্ড একত্রে, অনুবাদ: মওলানা মুফতী মুহাম্মদ জাকারিয়া, (মীনা বুক হাউস, ঢাকা ২০০৮), পৃষ্ঠা ১০৪৬।
- The History of al-Tabari, Volume 1- General Introduction and from the Creation to the Flood (trans. Franz Rosenthal, State University of New York Press, Albany 1989), pp. 187-193:
- পাঠকের কাছে এই মনুষ্যদৃষ্টিকোণ মানিয়ে নেওয়া কঠিন হলে, আমরা কোরআন শরীফে এমন মনুষ্যদৃষ্টিকোণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখতে পায়। সূরা আল-কাহ্ফ ১৮:৮৬ আয়াতে আমরা পড়ি যে মুসাফির যুল-কারনায়ন “চলিতে চলিতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌছিল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্গকিল জলাশয়ে অস্তগমন করিতে দেখিল।” বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্যের সংগে মিলানোর জন্য এই “সূর্যের অস্তগমনের স্থান” শুধু মনুষ্যদৃষ্টিকোণ থেকে এক বর্ণনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তেমনই ভাবে আমরা কিতাবের বর্ণনা সবসময় একটি কাল্পনিক দূর মহাকাশে অবস্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারি না।
- (John Warwick Montgomery, ed. Evidence For Faith [World Publishing, 1986], pp.108-109)
- আল-কোরআনুল করীম অনুবাদ (বাদশাহ্ ফাহ্দ বিন আব্দুল আজিজ, (খাদেমুল হারামীন শরীফীন) সৌদি আরব।
- Who moved the Stone? by Shaikh Ahmed Deedat.
- এই আয়াতগুলোতে “থাম” এর মূল হিব্রু শব্দ হল עמוד (‘আম্মুদ’), যার অর্থ শুধু “থাম” নয় বরং “মঞ্চ,” “ভিত্তি” বা “আলম্ব”– মহাদেশীয় প্লেটগুলোর নিচে ভূগর্ভস্থ স্তরের একটি উপযুক্ত বিবরণ। এখানে “দুনিয়া” শব্দের মূল হিব্রু শব্দগুলো (תּבל “তেবেল্” এবং ארץ “এরেৎস”) অনেক ক্ষেত্রে গোটা পৃথিবীকে বোঝায় না বরং নয় বরং “ভূখণ্ড” বা এক অঞ্চল বোঝায় (যেমন পয়দায়েশ ৩৮:৯ আয়াতে)।
- সূরা ফুসসিলাত ৪১:১২
- আল-কোরআনুল করীম অনুবাদ (বাদশাহ্ ফাহ্দ বিন আব্দুল আজিজ, (খাদেমুল হারামীন শরীফীন) সৌদি আরব।
- Dr Zakir Naik, Question on the Theory of Evolution (http://www.youtube.com/watch?v=OYmjLrzKNl8&feature=related)
- উল্লেখ্য যে অনেক ইতিহাসলেখক বলেন যে গ্যালিলিও ও ক্যাথলিক চার্চের বিতর্কের মূল কারণ ভূকেন্দ্রিকতাবাদ নয় বরং গ্যালিলিওর কর্কশ ব্যক্তিত্ব যেটা তার আসেপাশে সবাইকে শত্রুভাবাপন্ন করেন।
- De Boer, T. J. The History of Philosophy in Islam. London 1933.
- Pliny, Natural History, Vol I.
- Iqbal Latif, “Why the clergy has made our heroes our heretics?” in Global Politician, Nov 26, 2006.
- অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি পড়ার কর্তব্য নয় বরং সমাজের মধ্যে কয়েকজন জানা দরকার; “দলগত কর্তব্য”।
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:
Leave a Reply