সকল নবী কি নিষ্পাপ?
এখন পাপ সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করা দরকার। আল্লাহ্ যে নবী পয়গম্বরদের পাঠিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে একটি ভূল ধারণা প্রায় সব মানুষই পোষন করে আর তা হল যে সমস্ত নবীরাই নিষ্পাপ। এই ধারণা আল্লাহ্র কালাম ও সাধারণ যুক্তির বিপরীত। এটি সাধারণ যুক্তির বিপরীত কারণ নবীরাও আমাদের মতো আদমের বংশভূত এবং তাঁদেরও ওই একই গুনাহ্-স্বভাব ও আত্মকেন্দ্রিক জীবন ছিল। এটা আল্লাহ্র কালামের বিপরীত কারণ আল্লাহ্র কিতাবে নবীদের গুনাহ্ সম্পর্কে পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আল্লাহ্র কালাম নবীদের ভুল-ত্রু টি ও আল্লাহ্কে অমান্য করার ঘটনার সাথে তাঁদের গভীর ঈমান ও বাধ্যতার কথাও সুস্পষ্টভাবে বলে। নবীদের জীবন সম্পর্কে সুন্দর ব্যাপারটা হল, যদিও তাঁরা পাপ করেছিল তবুও তাঁরা তওবা করে আল্লাহ্র ক্ষমা পেয়েছিলেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, কোরআনে নবীরা যে সব পাপ করেছিলেন সে সব বিষয়ে পরিষ্কার বিশ্লেষণ না থাকলেও নবীরা আল্লাহ্র কাছে যে অনুশোচনা করেছেন তার উল্লেখ আছে। নবীদের অবাধ্যতার একটা পরিষ্কার চিত্র পেতে হলে এবং তাদেরকে কেন তওবা করতে বলা হয়েছে তা জানতে হলে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে খোঁজ করতে হবে। এই বিষয়ে কোরআনের কিছু অংশ নিচে দেওয়া হল। এই আয়াতগুলি পরিষ্কারভাবে বুঝায় যে নবীরাও পাপী ছিলেন আর আল্লাহ্র ক্ষমা তাঁদের দরকার ছিল।
হযরত মূসা (আঃ)
“এবং আশা করি, তিনি [আল্লাহ্] কিয়ামত দিবসে আমার আপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা শু’আরা’ ২৬:৮২)
হযরত ইবরাহীম (আঃ)
“সে [মূসা নবী] নগরীতে প্রবেশ করিল, যখন ইহার অধিবাসীরা ছিলো অসতর্ক। সেথায় সে দুইটি লোককে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখিল, একজন তাহার নিজ দলের এবং আপর জন তাহার শত্রুদলের। মূসার দলের লোকটি উহার শত্রুর বিরুদ্ধে তাহার সাহায্য প্রার্থনা করিল, তখন মূসা উহাকে ঘুসি মারিল; এইভাবে সে তাহাকে হত্যা করিয়া বসিল। মূসা বলিল, ইহা শয়তানের কাণ্ড। সে তো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান-কারী।” (কোরআন শরীফ, সূরা কাসাস ২৮:১৫-১৬)
হযরত ইউনুস (আঃ)
“ইউনুসও ছিলো রাসূলদের একজন। স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করিয়া বোঝাই নৌযানে পৌঁছিল, অতঃপর সে লটারীতে যোগদান করিল এবং পরাভুত হইল। পরে এক বৃহদাকার মৎস্য তাহাকে গিলিয়া ফেলিল, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগিল। সে যদি আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করিত, তা হইলে তাহাকে উত্থান দিবস পর্যন- থাকিতে হইত উহার উদরে। অতঃপর ইউনুসকে আমি নিক্ষেপ করিলাম এক তৃণহীন প্রান-রে এবং সে ছিলো রুগ্ন। পরে আমি তাহার উপর এক লাউ গাছ উদ্গত করিলাম, তাহাকে আমি এক লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করিয়াছিলাম। এবং তাহারা ঈমান আনিয়াছিল; ফলে আমি তাহাদিগকে কিছু কালের জীবনোপভোগ করিতে দিলাম।” (কোরআন শরীফ, সূরা সাফ্ফাত ৩৭:১৩৯-১৪৮)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
“এতএব তুমি [হে মুহাম্মাদ] ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি সত্য, তুমি তোমার ক্রটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর সকাল ও সন্ধ্যায়।” (কোরআন শরীফ, সূরা মুমিন ৪০:৫৫
“সুতরাং জানিয়া রাখ [হে মুহাম্মাদ], আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই, ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার এবং মু’মিন নর-নারীদের ক্রটির জন্য আল্লাহ্ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস’ান সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৯)
“নিশ্চয়ই [হে মুহাম্মাদ] আমি তোমাদিগকে দিয়াছি সুস্পষ্ট বিজয়, যেন আল্লাহ্ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত ক্রটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁহার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন, এবং আল্লাহ্ তোমাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন।” (কোরআন শরীফ, সূরা ফাত্হ ৪৮:১-৩)
গুনাহ্ ও তার খারাপ ফালাফল কী, তা ভালভাবে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ মনে করে যে বর্তমান সময়ে প্রচলিত কোন জনপ্রিয় প্রণালী বা তন্ত্র যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ ব্যবহারের দ্বারাই দারিদ্র, অসাম্য, দুর্দশার মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবসত, আল্লাহ্র কালাম আমাদের এই রকম এতো সহজ সমাধানের কথা বলে না। সব থেকে ভাল আবিস্কৃত তন্ত্রও মানুষের দ্বারাই চালিত যে নিজেই স্বার্থপর ও কুলষিত এবং তার পরিচালনায় তার তন্ত্র সমাজকে অবিচার ও কষ্টের মধ্যেই নিয়ে যায়।
মানব সমাজের সমস্যাটা বাহিরের এই পন্থাগুলো নিয়ে নয় বরং তা মানুষের হৃদয়ের ভিতরের পন্থাকে নিয়েই। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ প্রতিদিন গোসল করে ও নিত্য নতুন কাপড় পরিবর্তন করে পরিষ্কার থাকতে পারে ঠিকই কিন্তু সেভাবে যে রোগ তাকে ভিতর থেকে নিঃশেষ করে ফেলছে তাকে কিছুতেই সে দূর করতে পারবে না । মানব সমাজের এই বিশ্বজনীন যে নিপীড়ন তা কোন ভুল প্রথার জন্য নয়, তা বরং মানুষের পাপের জন্যই যা এই প্রথাগুলোকে পরিচালনা করে। অন্য দিকে, যদি একটা খারাপ প্রথা ভাল মানুষদের দ্বারা চালিত হয় তাহলে কিছু সময়ের মধ্যে তারা সেই প্রথাকে নির্ভুল করে তা ব্যবহার করে পৃথিবিকে কয়েক বছরের মধ্যেই বেহেশতে রূপান্তর করা সম্ভব হত।
প্রধান যে জিনিসটি যা আমাদের দরকার তা হল আমাদের হৃদয়ের পরিষ্কারকরণ । মন পরিবর্তন না হলে শুধু বাহিরকে পরিবর্তন করলেই হবে না। আদম-হাওয়ার পাপের মাধ্যমে যা বেঠিক হল তাকে আবার সঠিক করতে হবে। আমাদের স্বার্থপর কামনা বাসনা ও ইচ্ছা থেকে ফিরে আল্লাহ্র দিকে ফিরতে হবে যাতে আমরা তাঁর রাজ্যের ভাগি হতে পারি।
এই ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকেই দুইটি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি। প্রথমত, আমরা কি নিজেরা স্বীকার করতে রাজি আছি যে, আমি পাপি আর আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমা না পেলে কেয়ামতের দিনে শুধু ভর্তসনা ও শাস্তি আশা করতে পারি?
এই রকমই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসে। আমরা সবাই পাপ করেছি। আল্লাহ্ আমাদের যে শান্তি, আনন্দ এবং আশীর্বাদ দিতে চান আমাদের পাপ সেগুলো থেকে আমাদের দূরে রেখে আল্লাহ্র শাস্তি ও দোষারোপের কাছে আমাদের নিয়ে এসেছে। তাই এই পরের প্রশ্নটা হল; আমরা পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কি করতে পারি? আল্লাহ্র ক্ষমা আমরা কিভাবে পাব আর তাঁর সাথে আমাদের সর্ম্পকই বা কিভাবে ঠিক হবে? এই প্রশ্ন আমাদের ৩ নম্বর তত্ত্ব ও পরের পাঠে নিয়ে যায়।
ঈসা মসীহ্: একমাত্র নিষ্পাপ নবী
এর একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ঈসা আল-মসীহ্। তার অলৌকিক জন্মের ফলে হযরত ঈসা জন্ম থেকেই পুরোপুরি নিষ্পাপ ছিলেন (সূরা আলে-‘ইমরান ৩:৪৬ এবং মার্ইয়াম ১৯:১৯)। অন্যান্য সকল মানুষ আদিপিতা হযরত আদমের সন্তান হয়ে তার তার কাছ থেকে একটি গুনাহের স্বভাব উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। পাক-রূহের কুদরতীতে বিনা পিতায় জন্মিত, তিনি একটি পবিত্র এবং নিষ্পাপ জীবন যাপন করেছিলেন। এটা কোরআন এবং ইঞ্জিলে সুস্পষ্ট। সূরা মরিয়ম ১৯ আয়াতে, আল্লাহ্র ফেরেশতা জিবরাইল মরিয়মের কাছে বলল যে তার সন্তান হবে ‘পবিত্র’ বা ‘নিষ্পাপ’ (زَكِيًّا জাকীয়্ ):
قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا
“সে [আল্লাহ্র রূহ্] বলিল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালক-প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করিবার জন্য।’” (মার্ইয়াম ১৯:১৯)
ইঞ্জিলের শিক্ষার সঙ্গে এটা মিলে যায়, যেখানে বলা হয়েছে যে তিনি ‘গুনাহ্ করেন নি’ (ইবরানী ৪:১৫)। ঈসা মসীহ্ নিজেই বলেছিলেন, যখন ইহুদী আলেমগণ তাকে সমালোচনা করছিলেন, যে “আপনাদের মধ্যে কে আমাকে গুনাহ্গার বলে প্রমাণ করতে পারেন?” (ইউহোন্না ৮:৪৬)। তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারলেন না।
এমনকি সাহীহ্ হাদিসেও ঈসা মসীহ্র নিষ্পাপ স্বভাব সমর্থন করে—
– হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ প্রত্যেক আদম সন্তানকেই শয়তান ছুঁয়ে দেয়, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করে, শুধু মরিয়ম ও তাঁর ছেলে ছাড়া। (মুসলিম শরীফ #৫৯৭৮)১
- মোঃ জাকারিয়া অনূদিত সাহীহ্ মুসলিম (মীনা, ঢাকা ২০০৮), পৃষ্ঠা ৯০২.
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:
Leave a Reply