সৃষ্টির ধাপের ক্রম

পয়দায়েশ ১:১১-১৩–“দিন-রাত সৃষ্টি হওয়ার আগে কীভাবে সূর্য-চন্দ্র থাকতে পারে?”

 

পয়দায়েশের দিনগুলোর ক্রম

সমালোচকগণ দুনিয়া সৃষ্টির পর্যায়ক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই ‘রাত-দিন’ হতে পারে, অথবা কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই গাছ-পালা পৃথিবীতে জন্মাতে পারে। পয়দায়েশের ধাপগুলোর নিম্নের ব্যাখ্যা এসব ভুল ধারণাগুলোকে দূর করে।

মূলতঃ পয়দায়েশের প্রথম আয়াত যে দৃষ্টিকোণ স্থাপন করেছে তা হল পৃথিবীর পানির তল থেকে, যেখানে সৃষ্টির শেষে মানুষকে রাখা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির সব ধাপগুলো বর্ণনা করা হয় পয়দায়েশের প্রথম অধ্যায়ে, কোনো কাল্পনিক দূর মহাকাশে অবস্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। সঠিক দৃষ্টিকোণ বা দেখার অবস্থান পেলে সৃষ্টির ধাপগুলোর ক্রম নিয়ে অনেক ভুলধারণা দূর হয়ে যায়:

বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথ্য :

পয়দায়েশের বর্ণনা :

সৃষ্টির শুরু (১৪০০ কোটি বছর আগে)
বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি মহা বিস্ফোরণে সমস্ত কিছু শুরু হল।

“সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ্ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন।” (১ আয়াত)

পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থা (৪৫০ কোটি বছর আগে) আধুনিক বিজ্ঞানের মতে প্রথমে পৃথিবীর চারদিকে এতো বেশী আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা ছিল যে পৃথিবীর তলের অবস্থা পুরোপুরি অন্ধকার ও বিশৃঙ্খল ছিল। এই তথ্য পয়দায়েশ ১:১-২ বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়:

“দুনিয়ার উপরটা তখনও কোন বিশেষ আকার পায় নি, আর তার মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না; তার উপরে ছিল অন্ধকারে ঢাকা গভীর পানি। আল্লাহ্‌র রূহ্ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন।” (২ আয়াত)

বিশৃঙ্খলের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার ধাপগুলো :

প্রথম ধাপ:পৃথিবীর তলে দিনরাত উপলব্ধি
(৪৫০-৩০০ কোটি বছর আগে)
আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা আংশিক ভাবে অপসারণহয় এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আংশিক ভাবে রূপান্তর হয় যেন মহাকাশের আলো ঢুকে সমুদ্রের তলে দেখা দেয়।

প্রথম ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ বললেন, “আলো হোক।” আর তাতে আলো হল। তিনি দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে আলোর নাম দিলেন দিন আর অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল আর সকালও গেল, আর সেটাই ছিল প্রথম দিন।” (৩-৫ আয়াত)

দ্বিতীয় ধাপ: সমুদ্র-বায়ুমণ্ডল পৃথক হয়ে যাওয়া
(৩০০-২০০ কোটি বছর আগে)
বায়ূমণ্ডলের ক্রান্তি মন্ডলে (troposphere) বাষ্প গঠন হয় যেন স্থিতিশীল পানির চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়

দ্বিতীয় ‘ইয়ম’: “…তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হোক, আর তাতে পানি দু’ভাগ হয়ে যাক…” (৬-৮ আয়াত)

তৃতীয় ধাপ: মহাদেশ ও সমুদ্র আলাদা, উদ্ভিদ
(২০০-৭০ কোটি বছর আগে)
মহাদেশগুলো ভাগ হয়ে সমুদ্র ও মহাদেশে আলাদা হয়ে যায়, এবং প্রথম উদ্ভিদ ও গাছ

তৃতীয় ‘ইয়ম’: “…এর পর আল্লাহ্ বললেন, “আসমানের নীচের সব পানি এক জায়গায় জমা হোক এবং শুকনা জায়গা দেখা দিক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্ সেই শুকনা জায়গার নাম দিলেন ভূমি, আর সেই জমা হওয়া পানির নাম দিলেন সমুদ্র।” (৯, ১০ আয়াত)

চতুর্থ ধাপ: বায়ুমণ্ডলের রূপান্তর – সূর্য, চাঁদ ও তারা দেখা যায়
(৭০-৬০ কোটি বছর আগে)
এর আগে বায়ুমণ্ডল আলোকপ্রবাহী ছিল কিন্তু অস্বচ্ছ, অর্থাৎ আলো ঢুকে যেত কিন্তু সূর্যচন্দ্র দেখা যেত না; এই ধাপে বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ হয় এবং সূর্যচন্দ্র স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

চতুর্থ ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন (עשׂה – প্রকাশ করলেন)। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন।” (১৬ আয়াত)

পঞ্চম ধাপ: পানির মধ্যে জীব, প্রাণী
(৬০-২০ কোটি বছর আগে)
ছোট সামুদ্রিক প্রাণী বিবর্তন হয়

পঞ্চম ‘ইয়ম’: “তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানি বিভিন্ন প্রাণীর ঝাঁকে ভরে উঠুক, আর দুনিয়ার উপরে আসমানের মধ্যে বিভিন্ন পাখী উড়ে বেড়াক।” (২০ আয়াত)

ষষ্ঠ ধাপ: স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং মানব জাতি
(২০-১ কোটি বছর আগে)
স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর বিবর্তন এবং homo sapien এর উত্থান।

ষষ্ঠ ‘ইয়ম’: “আল্লাহ্ দুনিয়ার সব রকমের বন্য, গৃহপালিত এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী সৃষ্টি করলেন…পরে আল্লাহ্ তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন।” (২৫,২৭ আয়াত)

stages

কোরআন ও তৌরাত উভয় কিতাবেই আছে সমতুল্য কিছু রহস্যময় ঘটনার পর্যায়ক্রম। কোরআন শরীফের প্রধান সৃষ্টি-বর্ণনা সূরা ৪১:৯-১২ আয়াত অনুযায়ী, সাতটি আসমানের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সৃষ্টির পরে, যদিও বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী আসমান সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টির কোটি কোটি বছর পূর্বে। সূরা বাকারাহ্‌ ২৯ আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে—

“তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন।” (বাকারাহ্‌ ২৮)

তাহলে কোরআনের মধ্যেও আমরা এমন কালানুক্রমিক জটিলতা দেখতে পাই। তার মানে এই নয়, যে কোরআন ভুল, বরং আমরা দেখি যে সব কিতাবের মধ্যে কিছু জটিল বিষয় থাকে।

কিছু সমালোচক বলেন যে চতুর্থ দিনে সূর্য, চন্দ্র ও তারার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘তৈরী করা’, ‘দৃশ্যমান করা’ নয়। আসলে কিন্তু, এখানে হিব্রু “সৃষ্টি” বা “তৈরী” শব্দটি ব্যবহার হয় নি (בּרא, বারা), বরং עשׂה (‛আসাহ্‌) শব্দ ব্যবহার হয়েছে এখানে, যার অর্থ হতে পারে “দৃশ্যমান করা।” এই শব্দটি হিব্রু কিতাবে ১২০০ বার ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক ধরনের মানে বহন করে, যাদের মধ্যে “করা”, “তৈরি করা”, “দেখানো”, “আবির্ভাব”, “আবির্ভূত করা” ইত্যাদি। এই যুক্তির আলোকে আমরা অবশ্যই এই বলে শেষ করতে পারি যে সূর্য এবং চাঁদ প্রথম দিনে সৃষ্টি (৩য় আয়াত) হয়ে থাকলেও, চতুর্থ দিনে সূর্য এবং চাঁদ পৃথিবীর তলে দৃশ্যমান হয়।


১. উদাহরণস্বরূপ, পয়দায়েশ ৬:৩ এবং ১৯:১৪এতে ইয়মের অর্থ ‘দিন’ হতে পারে না বরং ‘সময়’কে বোঝায়।
২. জবুর শরীফের এই অধ্যায় হযরত মূসাকে আরোপ করা হয়েছে, যিনি ঐশী প্রেরণায় তৌরাতের পয়দায়েশ সৃষ্টিবর্ণনাও লিখেছে রেখেছেন।
৩. এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, Hugh Ross, Creator and the Cosmos, (Navpress, 2001) হ্যূহ্‌ রস, যিনি এই দিন-যুগ ব্যাখ্যার অন্যতম সমর্থক, তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ.ডি প্রাপ্ত একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং সাবেক ক্যাল-টেকের পোস্ট-ডক্তরাল গবেষক, এবং ভ্যানকুভার রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী ডাইরেক্টর অব অবসার্ভেশন্স।
৪. হ্যূহ্‌ রস লিখেন, “Prior to the Nicene Council, the early Church fathers wrote two thousand pages of commentary on the Genesis creation days, yet did not devote a word to disparaging each other’s viewpoints on the creation time scale. All these early scholars accepted that yom could mean “a long time period.” The majority explicitly taught that the Genesis creation days were extended time periods (something like a thousand years per yom). Not one Ante-Nicene Father explicitly endorsed the 24-hour interpretation.” [নাইসিয়া পরিষদের আগে, প্রথম চার্চ নেতাগণ পয়দায়েশের সৃষ্টির অনুচ্ছেদের বিষয়ে দু’হাজার পৃষ্ঠার তফসীর লিখেছেন, কিন্তু এক শব্দ দিয়েও এরা পরস্পরের সৃষ্টির সময় মতামত সমালোচনা করেন নি। এই সব শিক্ষার্থীগণ গ্রহণ করেছেন যে ‘ইয়ম’এর অর্থ হতে পারে “দীর্ঘকাল সময়।” এরা বেশির ভাগই সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষা দিতেন যে পয়দায়েশের সৃষ্টির দিনগুলো দীর্ঘ সময়ের মেয়াদ ছিল (যেমন প্রতি ইয়মে এক হাজার বছর)। নাইসিয়া পরিষদের আগে, একটাও নেতা সুনির্দিষ্টভাবে ২৪-ঘনটা ব্যাখ্যার সমর্থন দেন নি।] (The Genesis Debate, ed David Hagopian (Crux Press: Mission Viejo, 2001), p 125,126.
৫. হাদীস নং-৬৮৮৭, সহীহ্‌ মুসলিম শরীফ: সকল খণ্ড একত্রে, অনুবাদ: মওলানা মুফতী মুহাম্মদ জাকারিয়া, (মীনা বুক হাউস, ঢাকা ২০০৮), পৃষ্ঠা ১০৪৬।
৬. The History of al-Tabari, Volume 1- General Introduction and from the Creation to the Flood (trans. Franz Rosenthal, State University of New York Press, Albany 1989), pp. 187-193:
৭. পাঠকের কাছে এই মনুষ্যদৃষ্টিকোণ মানিয়ে নেওয়া কঠিন হলে, আমরা কোরআন শরীফে এমন মনুষ্যদৃষ্টিকোণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখতে পায়। সূরা আল-কাহ্‌ফ ১৮:৮৬ আয়াতে আমরা পড়ি যে মুসাফির যুল-কারনায়ন “চলিতে চলিতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌছিল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্গকিল জলাশয়ে অস্তগমন করিতে দেখিল।” বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্যের সংগে মিলানোর জন্য এই “সূর্যের অস্তগমনের স্থান” শুধু মনুষ্যদৃষ্টিকোণ থেকে এক বর্ণনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তেমনই ভাবে আমরা কিতাবের বর্ণনা সবসময় একটি কাল্পনিক দূর মহাকাশে অবস্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারি না।

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *