ইঞ্জিল শরীফ ও কোরআন শরীফে ভিন্নপাঠ এবং লিপিকারের ত্রুটি

আমরা সবাই একমত যে “আল্লাহ্‌র কালামের কোন পরিবর্তন নেই”, কারণ সেটা কোরআন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের স্পষ্ট সাক্ষ্য। তাই একটি পাণ্ডুলিপিতে কোন ভিন্নপাঠ বা ত্রুটি পাইলে, তাতে কি আল্লাহ্‌র কালামের বিশুদ্ধতা ভুলপ্রমাণ করে? অবশ্যই না, কারণ কোরআন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের মধ্যে এমন লিপিকারদের ত্রুটি আর প্রিন্টারের ভুল ছিল এবং আছে। শুধু গত মাসেই আমি আমার ইসলামি ফাউন্ডেশন কোরআন তরজমাতে পড়েছিলাম—

“আর যাহারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাহাদিগকে দাখিল করব জাহান্নামে” (সূরা নিসা ১২২)

এখানে ‘জান্নাত’-এর বদলে ‘জাহান্নাম’ ছাপানো হয়েছে। বই প্রকাশনীতে এরকম ভুল স্বাভাবিক, এবং মুদ্রাযন্ত্র আবেষ্কার হওয়ার আগে যখন হাতের লেখায় বই কপি করা হত তখন এগুলো আরও স্বাভাবিক ছিল। তাতে কি প্রমাণ হয় যে আল্লাহ্‌ কালাম পরিবর্তন করা সম্ভব? অবশ্যই না। আল্লাহ্‌ ছোটখাট ভিন্নপাঠ বা লিপিকরের ত্রুটির কথা বলছিলেন না বরং স্থায়ী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন।

কিন্তু যারা শুধু অশিক্ষিত ধর্মযাজকদের কথা জানে, আল্লাহ্‌ কালাম সম্বন্ধে তাদের একটি কাল্পনিক ধারণা আছে। বাস্তবতা হল যে কোরআন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে অনেক গুরুত্বহীন ছোটখাট ভিন্নপাঠ আছে। আগের যুগে ঈমানদার বুঝতে পারল যে এমন ভিন্নপাঠ অপরিহার্য ও গুরুত্বহীন এবং সেগুলোর অস্তিত্ব তারা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করত। কিন্তু আজকাল কিছু মুসলমান প্রচারক এগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করে যাচ্ছেন।

বর্তমান কালে তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল বা কোরআনের কোন ‘মূল কপি’ বিদ্যমান নেই, সেগুলো হারিয়ে গেছে। তবুও, সেগুলোর জন্য অনেক অনেক প্রাচীন পাণ্ডূলিপি রয়েছে। একটি ভুল ধারণা কিছু কিছু দেশে ছড়িয়ে গেছে যে তাসখন্দ বা সামারকন্দে অবস্থিত কোরআনের মুস্‌হাফ (কোরআনের ৩ ভাগের এক ভাগ) অথবা টপকাপিতে অবস্থিত পাণ্ডুলিপি হচ্ছে হযরত উসমান (রা)-এর ‘মূল’ কপি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন যে এগুলো হযরত উসমানের কপিগুলো নয়, যেহেতু সেগুলো আরবী কুফিক লিপিতে লেখা হয়েছে যা শুধু অষ্টম শতাব্দীর শেষে চালু হয়েছে। তাও, হযরত উসমান (রা)-এর কপিগুলো আবার মূল কপি ছিল না, কারণ ভিন্নপাঠ প্রমিত করার জন্য সেগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মৃত্যুর অনেক বছর পরে সংকলন করা হয়েছে, এবং সেগুলোর আগে অন্যান্য কোরআন শরীফের মুস্‌হাফ ছিল।

যেহেতু মুদ্রণের প্রযুক্তি মাত্র ৫০০ বছর আগে আবিষ্কার হয়েছে, প্রাচীন কালে কিতাবগুলো হাতে লেখায় কপি করা হত। সুশিক্ষিত আলেমেরা এই কাজ করতেন, এবং পরে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের কপিগুলো মিলিয়ে দেখত। এইজন্য হিব্রু ভাষায় এদেরকে বলা হত “ספרים সফিরিম’ (অর্থাৎ “গণনাকারী”) কারণ তাদের কপিগুলো মিলিয়ে দেখার সময়ে এরা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রত্যেকটি অক্ষর গুণত। তবে তাদের এতো চেষ্টার পরেও কিছু ছোটখাট ভুল এরা ধরতে পারেননি, বিশেষ করে সংখ্যা এবং নামগুলো। হিসাব করা হয়েছে যে গড়ে ১,৫৮০ অক্ষরের মধ্যে ১টা ভুল হত, এবং নতুন কপি করার সময়ে অনুককিছু আবার আগের অবস্থায় ঠিক করা হত। উল্লেখ্য যে কিতাবুল মোকাদ্দসের অধিকাংশ ভিন্নপাঠ তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলে পাওয়া যায় না বরং নবীদের কিতাবে রয়েছে।

এই ধরণের ভিন্নপাঠ আল্লাহ্‌র কিতাবের বিশুদ্ধতা বা সংরক্ষণ বাতিল করে না, কারণ ভিন্নপাঠের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির পার্থক্য তুলনা করলে বোঝা যায় কোনটা ঠিক এবং কোনট লিপিকরের ভুল। এই কাজের জন্য একটি বিজ্ঞান আছে যার নাম টেক্সটুয়াল বিশ্লেষণ। বর্তমান কালে হাজার হাজার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে এবং যেসব জায়গায় একটি পাণ্ডুলিপিতে ভুল আছে, অন্য পাণ্ডুলিপিতে সেই জায়গায় সঠিক মূল শব্দ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২ খান্দাননামা ২২:২ আয়াতে কিছু কিছু পাণ্ডুলিপিতে অহসিয়ের বয়স আছে ৪২ এবং কিছু কিছু পাণ্ডুলিপিতে আছে ২২, কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে বোঝা যায় যে ‘৪২’ হচ্ছে লিপিকরদের একটি ত্রুটি এবং ‘২২’ হচ্ছে সঠিক মূল সংখ্যা।

আজকালে কোরআনের সাতটি প্রচলিত ‘হরফ’ বা ‘কেরআত’ আছে। এগুলোর মধ্যে শুধু উচ্চারণের পার্থক্য নয় বরং বচনে, ক্রিয়াপদের কালে, শব্দের ক্রমে, এমনকি কিছু কিছু জায়গায় ভিন্ন শব্দও দেখা যায়। কিন্তু হযরত উসমান (রা) এর সংকলনের আগে, বিভিন্ন কোরআনের মধ্যে ভিন্নপাঠ ছিল। আব্দুর রহমান দই লিখেছেন যে কোরআনের ‘প্রমিত সংস্করণের চাহিদা এবং রাজনৈতিক অনুমোদন হওয়ার কারণে নতুন সংস্করণটা ক্রমে ক্রমে আগের ভিন্নপাঠগুলো দূর করেছে”

যেমন ধরুন, সূরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে লেখা আছে ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِي যালিকাল্‌ কিতাবু লা রায়বা ফী-হি হুদাঁললিল্‌ মুত্তাক্বীন (“এই হল কিতাব যার বিষয় সন্দেহ নাই, এ সাবধানীদের জন্য পথ-নির্দেশক”)। কিন্তু ইবনে মাসউদসহ অনান্য ক্বারী এইভাবে বলতেন, تَنْزِیلُ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ তানজিলুল কিতাবু লা রায়বা ফী-হি হুদাঁললিল্‌ মুত্তাক্বীন (এই হল নাজিলকৃত কিতাব যার বিষয় সন্দেহ নাই, এ সাবধানীদের জন্য পথ-নির্দেশক”)।

সূরা বাকারার শেষে ‘আয়াহ্‌ ১৯৮-এ ইবন মাসউদ أَن تَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّن رَّبِّكُمْ (আন তাবতাঘু ফাধলান মির-রাব্বিকুম( এর পরে যোগ দিয়েছেন فِي مَوْسِم الْحَجফী মাওয়াসেমেল হাজ্জ (‘হজ্জের মৌসুমে’)। আবার সূরা আল-‘ইমরান ১৯ আয়াতে আছে إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ “ইন্নাদ্দীনা ইনদ্দাল্লাহিল ইসলাম (‘আল্লাহ্‌র সামনে ধর্ম হচ্ছে ইসলাম’), কিন্তু ইবন মাসউদের পাঠে ‘ইসলাম’ শব্দের পরিবর্তে ছিল الْحَنَفِي ‘আল-হানাফীয়া’

সূরা আস্‌রে ভিন্নপাঠের উদাহরণ
 

সূরা আস্‌রে ভিন্নপাঠের উদাহরণ

(উৎস: কিতাবুল মাসাহিফ পৃষ্ঠা ১৯২, ১১১, ৫৫)

সূরা আলে-‘ইমরানের ৪৩ আয়াতের শেষে আছে, وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ “ওয়াস জুদীয় ওয়ার্‌কা’ঈ মা’আর-রাকে’ইয়ীন” (রুকুকারীদের সাথে সেজদা ও রুকু কর), কিন্তু ইবনে মাসঊদের পাঠ হল

وَارْكَعِي وَاسْجُدِي فِي سَجِدِين (সেজদাকারীদের সাথে রুকু ও সেজদা কর)

ইঞ্জিলের বিভিন্ন প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মধ্যে যেমন ছোটখাট ভিন্নপাঠ আছে, তেমনও কোরআন শরীফের সবচেয়ে প্রাচীন পান্ডুলিপির মধ্যে ভিন্নপাঠ আছে। নিচের তালিকায় এগুলোর কিছু উদাহরণ দেওয়া আছে:

কোরআন শরীফের বিভিন্ন প্রাচীন পান্ডুলিপির মধ্যে ভিন্নপাঠ

কোরআন শরীফের বিভিন্ন প্রাচীন পান্ডুলিপির মধ্যে ভিন্নপাঠ

এই ভাবে অনেক ভিন্নপাঠের উদাহরণ দেওয়া যায়। কোরআন শরীফের এসব ভিন্নপাঠ দিয়ে কোরআনের বিশুদ্ধতা ক্ষতি হয় না। একজন বিখ্যাত ভিন্নপাঠ দিয়ে তার বিশুদ্ধতা নষ্ট হয় না, তেমনই ভাবে ইঞ্জিলের তাফসীরবিদ বলেছিলেন, “ত্রুটি ছাড়া কম বই প্রকাশ হয়; কিন্তু সেগুলোর কারণে লেখকেরা সেগুলো অস্বীকার করে না, আবার মুদ্রণের ত্রুটিগুলো লেখকের ত্রুটি বলে গণ্য হয় না। কিন্তু সচেতন পাঠকেরা প্রসঙ্গ দেখে সেগুলো ধরে লেখার অন্য অংশের আলোকে সেগুলো ঠিক অরে।”

আবার কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদকেরা এই ভিন্নপাঠ লুকিয়ে রাখে না, বরং যেকোন ভাল ইংরেজি আক্ষরিক অনুবাদে সব উল্লেখযোগ্য ভিন্নপাঠ টীকাতে দেওয়া হয়। এই টীকাগুলো একটু দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যাবে ভিন্নপাঠগুলো কত কম এবং গুরুত্বহীন।


অন্যান্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ:

 

 

  1. Kergyma and Myth, Rudolph Bultmann, English trans. Harper & Row, New York, 1961, p.39.
  2. আল-কুরআনুল করীম বাংলা তরজমা (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ২০০৫), পৃষ্ঠা ১২৬
  3. দেখুন আত-তাবারি, খণ্ড ১, ২০; এবং সুয়ূতী, আল-ইতকান ফী উলুমুল কোরআন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬০; এবং বোখারী, ৬ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৯.
  4. মুফতী মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ, কুরআন সংকলনের ইতিহাস (দারুল কিতাব, ঢাকা, ২০০০), পৃষ্ঠা ১৫২.
  5. Abdur Rahman Doi, Qur’ān: An Introduction, p.27.
  6. কিতাবুল মাসাহিফ

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *