ঈসার শিক্ষা অনুযায়ী কি শরিয়ত দ্বারা নাজাত পাওয়া যায়?
ঈসা মসীহের অন্যান্য ভূমিকা এড়ানোর জন্য দুএকটি আয়াতের ভিত্তিতে (মথি ৫:১৭, মথি ১৯:১৬-৩০) বলা হয় যে তিনি শুধু শরিয়ত সমর্থন করতে আসলেন। এটাই তাদের অভ্যাস— দুএকটি আয়াত ভুল-ব্যাখ্যা করা এবং বাকি ৯৯ আয়াত অবহেলা করা। তাই আসুন, আমরা তৌরাত থেকে শুরু করে ভালভাবে দেখব কিতাবুল মোকাদ্দসে নাজাত এবং শরিয়তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করি:
তৌরাত শরীফে নাজাত
হযরত ঈসা যখন বার বার বললেন যে নাজাত শরিয়তের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না বরং রহমতের মাধ্যমে আসে, এটা কোন নতুন শিক্ষা ছিল না বরং তৌরাত এবং নবীদের কিতাবের শিক্ষার সঙ্গে মিলে যায়। তৌরাত শরীফ থেকে বলা হয়েছে যে নাজাত আসবে একজন ‘মসীহ্’ এর মাধ্যমে। পয়দায়েশে বলা হয়েছে যে ইবরাহিম “মাবুদের কথার উপর ঈমান আনলেন আর মাবুদ সেইজন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” (পয়দায়েশ ১৫:৬)—তার ঈমানের জন্য, প্রচেষ্টার জন্য নয়।
হযরত মূসার শরিয়তে, এমন কথা কোথাও বলা হয় নি যে ‘এই শরিয়ত পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে’:
“বনি-ইসরাইলরা, তোমরা আমার কথা শোন এবং সতর্ক হয়ে এই সব মেনে চল, যাতে দুধ আর মধুতে ভরা সেই দেশে যাবার পরে তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্র ওয়াদা অনুসারে তোমাদের উন্নতি হয় আর তোমরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠতে পার।”(দ্বিতীয়বিবরণ ৬:৩)
বনি-ইসরাইলীয়দের জন্য মূসার শরয়িত পালনের পুরস্কার বেহেশত নয়, বরং প্যালেষ্টাইনে শান্তি ও সফলতা। আবার এই শরিয়তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাপ সম্বন্ধে চেতনা, যেন আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ্র ইচ্ছা কী কী এবং যে আমরা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পালন করচ্ছি না।
জবুর শরীফে নাজাত
প্রথমত, দাউদ নবীর জবুর শরীফে বলা হয় যে আল্লাহ্র সামনে সকল মানুষ গুনাহ্গার এবং নাজাত পাওয়ার অযোগ্য:
“আমার অন্যায়ের মধ্যে আমি ডুবে গেছি;
তা এমন বোঝার মত হয়েছে যা আমি বইতে পারি না।” (জবুর ৩৮:৪)
“তোমার এই সেবাকারীর বিচার কোরো না,
কারণ তোমার চোখে কোন প্রাণীই নির্দোষ নয়।” (জবুর ১৪৩:২)
“তুমি আমার গুনাহের দিকে চেয়ে দেখো না;
আমার সমস্ত অন্যায় তুমি মাফ কর।” (জবুর ৫১:৯)
“আমার অন্তর নীরবে কেবল আল্লাহ্র অপেক্ষা করছে,
কারণ তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা।
কেবল তিনিই আমার উঁচু পাহাড় আর আমার উদ্ধার;
তিনিই আমার কেল্লা আমি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হব না।” (জবুর ৬২:১,২)
“হে মাবুদ, তুমি যদি অন্যায়ের হিসাব রাখ,
তবে হে মালিক, কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে?
কিন্তু তোমার কাছে মাফ আছে
মাবুদের কাছে অটল মহব্বত আছে,
আর তাঁর মুক্ত করার প্রচুর ক্ষমতাও আছে।
তিনিই ইসরাইলকে তার সব অন্যায় থেকে মুক্ত করবেন।” (জবুর ১৩০:৩,৭,৮)
তাই বার বার দেখা যায় যে সকল মানুষ, এমনকি দাউদ নবী নিজেই, নাজাতের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহ্র রহমতের উপর নীর্ভরশীল, এবং আল্লাহ্ নিজেই আমাদের “মুক্ত” করবেন। জবুর শরীফে বলা হয়েছে যে আল্লাহ্ আমাদের ‘মুক্ত’ করবেন একটি কাফফারা দিয়ে:
דִּבְרֵי עֲוֹנֹת גָּבְרוְּ מֶנִּי פְּשָׁעֵינוְּ אַתָּה תְכַפְּרֵם
“আমার অন্যায় কাজে আমি তলিয়ে আছি,
কিন্তু তুমিই আমাদের সব গুনাহের কাফ্ফারা দেবেন।” (জবুর ৬৫:৩)
কিছু অনুবাদে ‘মাফ করা’ দিয়ে অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু এই আয়াতের মূল হিব্রু শব্দ হল כּפר কফ্ফর , যার পূর্ণ অর্থ হচ্ছে একটি কাফ্ফারা বা মুক্তিপণের বিনিময়ে পাপ মোচন করা।
তৃতীয়ত আমরা জবুর শরীফে লক্ষ্য করি যে এই মুক্তি বা কাফ্ফারা ভবিষ্যতে হবে, তাই নবী দাউদ বলছেন যে তিনি “অপেক্ষা” করছেন। তাই সংক্ষেপে নাজাত সম্পর্কে তিনটি বিষয় দেখা যাচ্ছে:
১. আল্লাহ্র সামনে কেউ ধার্মিক নয়২. আল্লাহ্ একটি কাফ্ফারার মাধ্যমে তাদের পাপ মোচন করে তাদের মুক্ত করবেন৩. এই কাফ্ফারা ভবিষ্যতে এক সময় হবে
নবীদের কিতাবে নাজাত
হযরত ইবরাহিমের সময় থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল যে আল্লাহ্ নাজাতের ব্যবস্থা আসবে এহুদার বংশধরের মাধ্যমে (পয়দায়েশ ৪৯:১০) এবং দাউদের বংশধরের মাধ্যমে (২ শামুয়েল ৭:১২-১৪; জাকারিয়া ১২:১০)। ক্রমে ক্রমে নবীদের মাধ্যমে আল্লাহ্ এই মসীহ্র বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছিলেন। নবী ইশাইয়া তাকে এইভাবে বর্ণনা করেছিলেন:
“তিনি তাঁর কষ্টভোগের ফল দেখে তৃপ্ত হবেন; মাবুদ বলছেন, আমার ন্যায়বান গোলামকে গভীরভাবে জানবার মধ্য দিয়ে অনেককে ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে, কারণ তিনি তাদের সব অন্যায় বহন করবেন।” (ইশাইয়া ৫৩:১১)
“আমাদের গুনাহের জন্যই তাঁকে বিদ্ধ করা হয়েছে; আমাদের অন্যায়ের জন্য তাঁকে চুরমার করা হয়েছে। যে শাস্তির ফলে আমাদের শান্তি এসেছে সেই শাস্তি তাঁকেই দেওয়া হয়েছে; তিনি যে আঘাত পেয়েছেন তার দ্বারাই আমরা সুস্থ হয়েছি।” (ইশাইয়া ৫৩:৫)
“আমরা সবাই ভেড়ার মত করে বিপথে গিয়েছি; আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের পথের দিকে ফিরেছি। মাবুদ আমাদের সকলের অন্যায় তাঁর উপর চাপিয়েছেন।” (ইশাইয়া ৫৩:৬)
ঈসা মসীহ্ দাবী করেছিলেন যে তিনিই এই মসীহ্ ছিলেন। শরিয়ত এবং নাজাত সম্বন্ধে ইঞ্জিলের মূল শিক্ষা এই: শরিয়ত ভাল, কিন্তু শরিয়তের মাধ্যমে নাজাত অর্জন করা যায় না কারণ আমরা শরিয়ত পালন করিনি; নাজাত আসে শুধুমাত্র আল্লাহ্র রহমতের দানের মাধ্যমে, এবং সেই রহমতের দান হচ্ছে ঈসা মসীহ্র চুড়ান্ত আত্মোৎসর্গ এই নাজাতের অংশীদার হওয়া যায় যদি আমরা এই দান গ্রহণ করে ঈসার অনুসারী হই। এই সংক্ষিপ্ত কালিমার বিরুদ্ধে ইঞ্জিলে কোন আয়াত নাই, বরং এর সমর্থনে ইঞ্জিলে শত শত আয়াত আছে।
মসীহ্র নিজের কথা
হযরত ঈসা কি কেবল শরিয়ত সমর্থন করতে আসলেন?
ঈসা বলেন, “আমার পিতার ইচ্ছা এই- আপনাদের মধ্যে যাঁরা পুত্রকে দেখে তাঁর উপর ঈমান আনেন তাঁরা যেন অনন্ত জীবন পান। আর আমিই তাঁদের শেষ দিনে জীবিত করে তুলব।” (ইউহোন্না ৬:৪০)
ঈসা বলেছেন যে তার রক্ত “অনেকের গুনাহের ক্ষমার জন্য দেওয়া হবে।” (মথি ২৬:২৮)
ঈসা বলেন, “যেন যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে অনন্ত জীবন পায়।” (ইউহোন্না ৩:১৫)
ঈসা বলেন, “মনে রেখো, ইব্নে-আদম সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন।” (মথি ২০:২৮; মার্ক ১০:৪৫)
ঈসা বলেন, “আমিই দরজা। যদি কেউ আমার মধ্য দিয়ে ভিতরে ঢোকে তবে সে নাজাত পাবে।” (ইউহোন্না ১০:৯)
“ঈসা থোমাকে বললেন, “আমিই পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারবে না।” (ইউহোন্না ১৪:৬)
ঈসা বলেন, “আমিই তাকে শেষ দিনে জীবিত করে তুলব…যে কেউ আমার উপর ঈমান আনে সে তখনই অনন্ত জীবন পায়…আমিই জীবন-রুটি…এই রুটি যে খাবে সে চিরকালের জন্য জীবন পাবে। আমার শরীরই সেই রুটি।” (ইউহোন্না ৬:৪৪,৪৭,৪৮,৪১)
ঈসা বলেন, “আমিই উত্তম মেষপালক। উত্তম মেষপালক তার মেষদের জন্য নিজের জীবন দেয়।” (ইউহোন্না ১০:১১)
ঈসা বলেন, “আমি তাদের অনন্ত জীবন দিই। তারা কখনও বিনষ্ট হবে না এবং কেউই আমার হাত থেকে তাদের কেড়ে নেবে না।” (ইউহোন্না ১০:২৮)
“ঈসা মার্থাকে বললেন, “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন। যে আমার উপর ঈমান আনে সে মরলেও জীবিত হবে।” (ইউহোন্না ১১:২৫)
ঈসা বলেন, “এই সব কথা বলবার পরে ঈসা আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পিতা, সময় এসেছে। তুমি তাঁকে সমস্ত মানুষের উপরে অধিকার দিয়েছ, যেন যাদের তুমি তাঁর হাতে দিয়েছ তাদের সবাইকে তিনি অনন্ত জীবন দিতে পারেন।” (ইউহোন্না ১৭:১-২)
ঈসা বলেন, “তোমাকে, অর্থাৎ একমাত্র সত্য আল্লাহ্কে আর তুমি যাঁকে পাঠিয়েছ সেই ঈসা মসীহ্কে জানতে পারাই অনন্ত জীবন।” (ইউহোন্না ১৭:৩)
ঈসা বলেন, “এই সমস্ত কষ্ট ভোগ করে কি মসীহের মহিমা লাভ করবার কথা ছিল না? এর পরে তিনি মূসার এবং সমস্ত নবীদের কিতাব থেকে শুরু করে গোটা পাক-কিতাবের মধ্যে তাঁর নিজের বিষয়ে যা যা লেখা আছে তা সবই তাঁদের বুঝিয়ে বললেন।” (লূক ২৪:২৬-২৭)
“ঈসা বললেন, “আরও অনেক জায়গায় আমাকে আল্লাহ্র রাজ্যের সুসংবাদ তবলিগ করতে হবে, কারণ এরই জন্য আল্লাহ্ আমাকে পাঠিয়েছেন।” (লূক ৪:৪৩)
“ঈসা বললেন, “আল্লাহ্ যাঁকে পাঠিয়েছেন তাঁর উপর ঈমান আনাই হল আল্লাহ্র কাজ।” (ইউহোন্না ৬:২৯)
ঈসা বলেন, “বেহেশত থেকে নেমে এসে যিনি মানুষকে জীবন দেন তিনিই আল্লাহ্র দেওয়া রুটি…আমিই সেই জীবন-রুটি।” (ইউহোন্না ৬:৩৩,৩৫)
ঈসা বলেন, “আমি যে পানি দেব, যে তা খাবে তার আর কখনও পিপাসা পাবে না। সেই পানি তার দিলের মধ্যে উথলে-ওঠা ঝর্ণার মত হয়ে অনন্ত জীবন দান করবে।” (ইউহোন্না ৪:১৪)
ঈসা বলেন, “পিতা যেমন মৃতদের জীবন দিয়ে উঠান ঠিক তেমনি পুত্রও যাকে ইচ্ছা করেন তাকে জীবন দেন।” (ইউহোন্না ৫:২১)
হযরত ঈসার অনেক গল্প থেকে বোঝা যায় যে নাজাত অর্জন করা যায় না বরং সেটা একটি বিনামূল্য দান:
- ক্ষমাহীন কর্মচারীর গল্প (মথি ১৮:২১-৩৫)
- আংগুর ক্ষেতের মজুরের গল্প (মথি ২০:১-১৬)
- বিয়ের মেজবানীর গল্প (মথি ২২:১-১০)
- হারানো ছেলের গল্প (লূক ১৫:১১-২৩)
ঈসা মসীহ্ বার বার জোর দিয়েছিলেন যে তার মৃত্যু ও পুনরুত্থান ছিল তার জীবনের প্রধান কাজ (মথি ১৭:২২, মার্ক ৯:৩১, মথি ২০:১৭, মথি ১৭:৯)।
তারপর ঈসা মসীহ্র বারজন শিষ্যদের সাক্ষ্যও রয়েছে যারা তিন বছর ধরে তার দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন:
১. হযরত পিতর বলেছিলেন:
“আপনারা প্রত্যেকে গুনাহের মাফ পাবার জন্য তওবা করুন এবং ঈসা মসীহের নামে তরিকাবন্দী গ্রহণ করুন। আপনারা দান হিসাবে পাক-রূহ্কে পাবেন।” (প্রেরিত ২:৩৮, ঈসার বেহেশতে ফিরে যাওয়ার কয়েক দিন পরে)
২. হযরত পিতর বলেছিলেন:
“নাজাত আর কারও কাছে পাওয়া যায় না, কারণ সারা দুনিয়াতে আর এমন কেউ নেই যার নামে আমরা নাজাত পেতে পারি।”” (প্রেরিত ৪:১২, ঈসার বেহেশতে ফিরে যাওয়ার কয়েক দিন পরে)
৩. পিতর বলেছিলেন:
“সোনা বা রূপার মত ক্ষয় হয়ে যাওয়া কোন জিনিস দিয়ে তোমাদের মুক্ত করা হয় নি; তোমাদের মুক্ত করা হয়েছে নির্দোষ ও নিখুঁত মেষ-শাবক ঈসা মসীহের অমূল্য রক্ত দিয়ে।” (১ পিতর ১:১৮,১৯)
৪. পিতর বলেছিলেন:
“তিনি ক্রূশের উপরে নিজের শরীরে আমাদের গুনাহের বোঝা বইলেন, যে আমরা গুনাহের দাবি-দাওয়ার কাছে মরে আল্লাহ্র ইচ্ছামত চলবার জন্য বেঁচে থাকি। তাঁর গায়ের ক্ষত তোমাদের সুস্থ করেছে।” (১ পিতর ২:২৪) পিতর এই-ও বলেছিলেন: “আমাদের হযরত ঈসা মসীহের শক্তি ও তাঁর আসবার বিষয় তোমাদের কাছে জানাতে গিয়ে আমরা কোন বানানো গল্প বলি নি; আমরা তাঁর মহিমা নিজেদের চোখেই দেখেছি।” (২ পিতর ১:১৬)
৫. ইয়াকুব বলেছিলেন:
“যে লোক সমস্ত শরীয়ত পালন করেও মাত্র একটা বিষয়ে গুনাহ্ করে সে সমস্ত শরীয়ত অমান্য করেছে বলতে হবে।” (ইয়াকুব ২:১০)
৬. ইউহোন্না বলেছিলেন:
“আমার প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা যাতে গুনাহ্ না কর সেইজন্যই আমি তোমাদের কাছে এই সব কথা লিখছি। তবে যদি কেউ গুনাহ্ করেই ফেলে তাহলে পিতার কাছে আমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলবার জন্য একজন আছেন; তিনি ঈসা মসীহ্, যিনি নির্দোষ। আমাদের গুনাহ্ দূর করবার জন্য মসীহ্ তাঁর নিজের জীবন কোরবানী করে আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করেছেন। কেবল আমাদের গুনাহ্ নয়, কিন্তু সমস্ত মানুষের গুনাহ্ দূর করবার জন্য তিনি তা করেছেন।” (১ ইউহোন্না ২:১,২)
হযরত ঈসার বাণী অবহেলা না করার সতর্ক
হযরত ঈসা প্রত্যেক মানুষের কাছে একটি উত্তর দাবি করেন। ঈসাকে বিশ্বাস করা শুধু তাকে ‘নবী’ বলা নয় বরং তার নিজের কথা ও দাবিগুলো গ্রহণ করতে হবে; নাহলে তুমি একটি মনগড়া ঈসাকে বিশ্বাস করছ। একজনকে ‘বিশ্বাস করা’ এবং পাশাপাশি তার শিক্ষা অস্বীকার করা সম্ভব না। যেহেতু মসীহ্ দাবি করেছেন যে তিনি সেই “মনোনীত নাজাতদাতা”, সেহেতু তার এই দাবিগুলো এড়িয়ে যাওয়া একটি ভয়ংকর বিষয়:
ঈসা বলেছিলেন:
“আপনারা আপনাদের গুনাহের মধ্যে মরবেন। যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন যে, আমিই সেই, তবে আপনাদের গুনাহের মধ্যেই আপনারা মরবেন।” (ইউহোন্না ৮:২৪)
ঈসা বলেছিলেন: “যে আমাকে অগ্রাহ্য করে এবং আমার কথা না শোনে তার জন্য বিচারকর্তা আছে। যে কথা আমি বলেছি সেই কথাই শেষ দিনে তাকে দোষী বলে প্রমাণ করবে” (ইউহোন্না ১২:৪৮)
ঈসা বলেছিলেন: “যদি আমি সত্যি কথাই বলি তবে কেন আপনারা আমাকে বিশ্বাস করেন না? যে লোক আল্লাহ্র, সে আল্লাহ্র কথা শোনে। আপনারা আল্লাহ্র নন বলে আল্লাহ্র কথা শোনেন না।” (ইউহোন্না ৮:৪৬,৪৭)
ঈসা বলেছিলেন: “যারা আমাকে অগ্রাহ্য করে, আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তারা তাঁকেই অগ্রাহ্য করে।” (লূক ১০:১৬)
ঈসা বলেছিলেন: “যে কেউ আমাকে লোকদের সামনে স্বীকার করে, আল্লাহ্র ফেরেশতাদের সামনে ইবনে-আদম তাকে স্বীকার করবে, কিন্তু যে কেউ আমাকে লোকদের সামনে অস্বীকার করে তাকে আল্লাহ্র ফেরেশতাদের সামনে অস্বীকার করা হবে।” (ইউহোন্না ৮:২৪)
শরিয়তের বাহক নাকি সুসংবাদের বাহক?
ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে ঈসার আসবার সময়ে প্যালেষ্টানে মূসার শরিয়তের অনেক অনেক ভক্ত ছিল, অনেক ইহুদী ‘রাব্বী’ (উস্তাদ) যারা মূসার শরিয়ত পুঙ্খানপুঙ্খ ভাবে পালন করার জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন, যেমন রাব্বি হিল্লেল, রাব্বি গামালিয়েল, এবং ফরীশীগণ। এরকম আরেকজন রাব্বি হওয়ার জন্য ঈসাকে পাঠানোর কোনো কারণ ছিল না।
ইঞ্জিল এবং কোরআন উভয়ই বলেন যে ঈসা “সুসংবাদ” আনতে আসলেন (‘ ইঞ্জিল’, اِنْجِيل) । একটি হাজার বছর পুরানো সুপরিচিত শরিয়ত মনে করিয়ে দেওয়া কোন ‘সুখবর’ হতে পারে না! কিন্তু আল্লাহ্র মাধ্যমে পাপ থেকে নাজাত পাওয়ার উপায় হল একটি আশ্চর্য সুখবর। ঈসার শিক্ষা এবং সেই শরিয়ত-শিক্ষকদের শিক্ষার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিল, এবং ঈসা মসীহ্ তাদের সম্বন্ধে বললেন,
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা লোকদের সামনে বেহেশতী রাজ্যের দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাতে নিজেরাও ঢোকেন না আর যারা ঢুকতে চেষ্টা করছে তাদেরও ঢুকতে দেন না।” (মথি ২৩:১৩)
তিনি এই কথা বলেছিলেন কারণ এরা শরিয়তের প্রকৃত ভূমিকা বিকৃত করে সেটা একটি নাজাত অর্জন করার মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরছিলেন।
মথি ১৯:১৬-৩০ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা
এখন আসুন সেই ধনী যুবকের ঘটনা একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। ঈসার কাছে তার প্রশ্ন ছিল,
“হুজুর, অনন্ত জীবন পাবার জন্য আমাকে ভাল কি কাজ করতে হবে?” (১৬ আয়াত)
তার এই প্রশ্ন থেকে বোঝা যায় যে তিনি শরিয়তকে একটি নাজাতের মাধ্যম মনে করতেন। কিন্তু ঈসা মসীহ্ উত্তর দিলেন,
“ভালোর বিষয়ে কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছ? ভাল মাত্র একজনই আছেন। যদি তুমি অনন্ত জীবন পেতে চাও তবে তাঁর সব হুকুম পালন কর।”
এখানে মসীহ্ সে যুবককে বলেছেন যে আসলে, প্রকৃত “ভাল”, অর্থাৎ ১০০% ভাল এবং নাজাত পাওয়ার যোগ্য, পৃথিবী জুড়ে মাত্র একজনই আছেন। তাঁকে ছাড়া প্রত্যেকটি ব্যক্তি কোন না কোন ভাবে শরিয়ত অমান্য করেছেন এবং “ভাল” নয় বরং অযোগ্য হয়েছে। এখানে ঈসা মসীহ্ সেই ধনী যুবক বোঝাতে চাচ্ছিল যে, তিনি সমস্ত শরিয়ত পালন করি নি বরং কোন না কোন ভাবে শরিয়ত ভেঙেছে।
সমালোচকেরা দ্বিতীয় আয়াতে থেমে যায়, কিন্তু আমরা যদি অনুচ্ছেদের শেষ পর্যন্ত পড়ি, তবে দেখা যায় ঈসা মসীহ্ সেই যুবকের কাছে প্রমাণ করেন যে তিনি পুরোপুরিভাবে শরিয়ত পালন করছে না, অর্থাৎ তারও রহমতের দরকার আছে। সেই যুবকের প্রথম প্রশ্ন (“অনন্ত জীবন পাবার জন্য আমাকে ভাল কি কাজ করতে হবে?”) এর শেষ উত্তর হিসেবে মসীহ বলেছিলেন “আমাকে অনুসরণ কর” (মথি ১৯:২১) – এটাই হচ্ছে অনন্ত জীবন পাওয়ার রাস্তা।
এর পরে ঈসার উম্মতগণ এতে আশ্চর্য হয় যে, এমন ভাল ও ধার্মিক যুবকের পক্ষেও নাজাত অর্জন করা সম্ভব নয়, এবং বলে “”তাহলে কে নাজাত পেতে পারে?” (২৫ আয়াত)। ঈসা তাদের বললেন, “মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব বটে, কিন্তু আল্লাহ্র পক্ষে সবই সম্ভব।” অর্থাৎ, মানুষের পক্ষে নাজাত অর্জন করা অসম্ভব, কিন্তু আল্লাহ্ নিজেই তাদের জন্য একটি নাজাতের রাস্তা প্রস্তুত করেছেন। তাই এই অনুচ্ছেদে শরিয়ত দ্বারা নাজাত অর্জন করার শিক্ষা নাই, বরং তার বিপরীত, যে শরিয়তের মাধ্যমে নাজাত অর্জন করা যায় না।
মথি ৫:১৭-২০ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা
এই অনুচ্ছেদে, ঈসা মসীহ্ দাবী করেছিলেন যে তিনি মূসার শরিয়ত বাতিল করতে আসেননি বরং “পূর্ণ” করতে এসেছিলেন। ঈসা মসীহ্ উদ্দেশ্য যদি শুধুমাত্র শরিয়ত পুনর্বহাল বা সমর্থন করা হত, তাহলে তিনি অবশ্যই এই “পূর্ণ” শব্দ ব্যবহার করতেন না। সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী, “পূর্ণ” এর সংজ্ঞা “সফল”, “সিদ্ধ”, “সমাপ্ত”—যা সুসংবাদের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে যায়। ঈসা মসীহ্ শরিয়ত ফেলে দেননি, একমাত্র তিনিই শরিয়ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করেছিলেন, অর্থাৎ “পূর্ণ” করেছিলেন।
অন্যদিকে, মূসার শরিয়তের মধ্যে তার বিষয়ে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বানী ছিল যেগুলো তিনি “পূর্ণ” করেছিলেন। এর পরের আয়াতে তিনি বলেন যে আখিরাত পর্যন্ত তৌরাত শরীফের এক বিন্দু কি এক মাত্রা মুছে যাবে না—সমালোচকেরা কেন ১৭ আয়াত মানে কিন্তু এই আয়াত মানে না?
মূসার শরিয়ত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায় –আনুষ্ঠানিক, নৈতিক, এবং রাষ্ট্রীয়। আনুষ্ঠানিক নিয়মগুলো (বাইতুল মোকাদ্দসে ইহুদীদের কোরবানীর ব্যবস্থা) অবশ্য মসীহের চুড়ান্ত কোরবানীর মাধ্যমে “পূর্ণ” হয়েছে (অর্থাৎ সমাপ্ত হয়েছে)। এর একটি আশ্চর্য সমর্থক হিসেবে মসীহের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ৪০ বছর পরে ইহুদীদের কোরবানীর ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
মূসার শরিয়তের রাস্ট্রীয় নিয়মগুলো বনি-ইসরাইলের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা ছিল, অন্যান্য জাতির জন্য নয়।
মূসার শরিয়তের নৈতিক নিয়মগুলো (দশটি হুকুম, ইত্যাদি) কিন্তু সমস্ত মানব জাতির জন্য (ইহুদী, খ্রীষ্টান, মুসলিম) দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত, কারণ এই নৈতিক নিয়মগুলোর ভিত্তি স্বয়ং আল্লাহ্রই চরিত্র। ১৯ আয়াতে হযরত ঈসা শরিয়তের এই নৈতিক ভাগের কথা বলছেন। শরিয়ত দ্বারা নাজাত অর্জন করা সম্ভব না, কিন্তু আমাদের ঈমানের ফলে অবশ্যই ধার্মিকতা দেখা যেতে হবে।
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:
Leave a Reply