“ঈসা মসীহ্‌কে কেন ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়?”

“ঈসা মসীহ্‌কে কেন ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়?”

value=”http://www.youtube.com/v/LZV5IqsMWUE?version=3&autohide=1&rel=0″> type=”application/x-shockwave-flash”wmode=”transparent”allowscriptaccess=”always”width=”100%”>

উদাহরণস্বরূপ কোন এক সময়ে ইসলামের অনুসারীদের এক অংশের মধ্যে বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল যে, আল্লাহ্‌তা’আলার দেহ বা হাত পা ছিল। তারা বিশ্বাস করত, আল্লাহ্‌ ছিল হাত, মুখ ইত্যাদি দৈহিক অঙ্গপ্রতঙ্গ ধারণকারী। কোরআন ও হাদিসের অংশ বিশেষের আক্ষরিক বর্ণনার ফলে, এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করে তুলেছেন। যেমন ইসলামী দর্শনে লেখা আছে

“এদের (যাহারিয়া ও মুশাব্বিহা) মতে, আল্লাহ্‌ শরীরী, আপন আসনে আসীন। তাঁর হাত মুখ আছে। তিনি রসুল করীমের পবিত্র স্কন্ধে হাত রাখেন এবং রসুল করীমও তার হাতের স্নিগ্ধতা অনুভব করেন।”

পরবর্তীতে অবশ্যই ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, আক্ষরিক দৃষ্টিকোণে ঐ সব অংশের ব্যাখ্যা দেয়া বা গ্রহণ করা যাবে না। ঐ সব অংশকে সব সময় অলংকারিক রূপক অর্থে গণ্য করতে হবে।

রূপক ব্যাখ্যা

এক সময়ে এটা বুঝতে পারা গেল যে, ধর্মগ্রন্থের কোন কোন অংশকে রূপকভাব অবশ্যই গণ্য করতে হবে। এর পরে কীভাবে অন্যান্য কঠিন অংশগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যেমন নিম্নলিখিত হাদিসগুলো আক্ষরিক অর্থে বুঝতে খুবই কষ্টকর ছিল। রসুল করিম বলেছিলেন:

“কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) হলো আল্লাহ্‌র হাত।”

“মুসলমানের অন্তর আল্লাহ্‌র আঙ্গুলসমূহের মধ্যে অবস্থিত।”

“আমি ইয়ামেন থেকে আল্লাহ্‌র খোশবু পাচ্ছি”

এখানে অপ্রত্যক্ষ এবং রূপক ব্যাখ্যা গ্রহণ করায় সমস্ত অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়েছে এবং প্রকৃত অর্থ স্পষ্টরূপে ভেসে উঠেছে।

আগেকার ভুল বুঝাবুঝি

উক্ত প্রকৃতির ধর্মীয় ভুল বুঝাবুঝি শুধুমাত্র কোরআন এবং হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলের মধ্যেও এমন বহু ব্যাখ্যার জটিলতা আছে। যেমন, নবিদের উপাধিগুলো নিয়ে সহজেই ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা সম্ভব।

ইবরাহিম খলিলুল্লাহ্‌

উদাহরণস্বরূপ আমরা হযরত ইবরাহিম (আঃ) সম্বন্ধে একটু চিন্তা করতে পারি। তাঁকে উপাধিটা দেয়া হয়েছিল ‘খলিলুল্লাহ্‌’ বা ‘আল্লাহ্‌র দোস্ত’। এখানে যারা আক্ষরিক অর্থ উপাধিটা বুঝতে চায়, তাদের অনেক জটিলতা ও সমস্যা রয়েছে। কারণ মানুষের দোস্ত থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্‌র দোস্ত থাকা কেমন করে সম্ভব? একজন মানুষ তার বন্ধুর সাথে উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া করে, এবং তার কাছে পরামর্শ পায়। জগতের দিক দিয়ে ‘দোস্ত’ শব্দটা সেই অর্থে বুঝায়। কিন্তু সে অর্থে কি আল্লাহ্‌র দোস্ত কোন দিন থাকতে পারে? কখনও না। বরং এর নিশ্চিত অর্থ হলো রূপক।

এ স্পষ্ট যে, সর্বশক্তিমান ও নিরাকার আল্লাহ্‌তা’আলার সাথে হযরত ইবরাহিম (আঃ) উঠা-বসা ও খাওয়া-দাওয়া করেননি বা তার কাছে পরামর্শের জন্য যাননি। আর তা করা সম্ভবও ছিল না। বরং আল্লাহ্‌র কাছে ইবরাহিম নবী তাঁর জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করলেন। আল্লাহ্‌র হুকুমে তিনি তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ী ও আত্মীয়স্বজন সবাইকে ত্যাগ করে অন্য এক দেশে চলে গেলেন। সব সময় তিনি আল্লাহ্‌র অনুগত ছিলেন এবং আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট রাখার জন্য চেষ্টাই তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সেইজন্য এখানে ‘খলিলুল্লাহ্‌’-এর স্পষ্ট অর্থ হলো আক্ষরিক নয় বরং রূপক। আল্লাহ্‌তা’আলার সাথে ইবরাহিম নবীর ঘনিষ্ঠ রূহানিক বা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল বলে তাঁকে বলা হয় ‘খলিলুল্লাহ্‌’। রূপক অর্থে তিনি আল্লাহ্‌র দোস্ত ছিলেন, জাগতিক অর্থে নয়।

আল্লাহ্‌র পুত্র

তারপর কিতাবের আর একটি উপাধি আছে যার সঠিক ব্যাখ্যা করার পিছনে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সে উপাধি হলো ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ এবং সেটাকে নিয়ে নিঃসন্দেহেই ব্যাপক ও কঠিন ভুল বুঝাবুঝি অবকাশ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ শব্দটা সমগ্র ইহুদী জাতিকে জড়িত করে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঈসা মসীহ্‌কে জড়িত করে ফেলে। কেমনভাবে, কোন অর্থে এই বিশেষ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর মূল তাৎপর্য কি তা উপলব্ধি করার জন্য আসুন, আমরা কিছু সময় ব্যয় করি।

আক্ষরিক অর্থ নয় বরং রূপক

যারা এই অভিধানিক শব্দটার আপত্তি তুলেছে তারা এর আক্ষরিক অর্থকে গ্রহণ করেছে এবং এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করায় তাদেরকে অনেক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করলে, এ মেনে নিতে হবে যে, আল্লাহ্‌র একজন স্ত্রী ছিল এবং আল্লাহ্‌ দৈহিক প্রক্রিয়ায় সন্তানাদির জন্ম দিয়েছিলেন (নাউজুবিল্লাহ্‌)। কিন্তু ইঞ্জিলের নিজস্ব শিক্ষাই পরিষ্কার রূপে এমন একটি মারাত্মক ভুলের বিরোধিতা করেছে। ঈসা মসীহ্‌ নিজেই ইঞ্জিল শরীফের সাক্ষ্য দিয়েছেন যে আল্লাহ্‌ এক এবং তাঁর কোন শরিক নেই। উনি মানুষকে হেদায়েত করলেন এভাবে:

“আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌কে মহব্বত করবে।” (মার্ক ১২:২৯,৩০)

ইঞ্জিল কিতাব আরো পরিষ্কার শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ্‌র কোন দেহ নেই। আল্লাহ্‌ প্রাকৃতিক নিয়মে বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান জন্ম দান করেন, এই ধারণা যেমন অসম্ভব তেমনি জঘন্য ও কুৎসিকতাপূর্ণ। অতএব যারা ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ এর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করবে; তারা তাদের মতো একই সমস্যায় পতিত হবে যারা কোরআন ও হাদিসের উপরোক্ত অংশের ব্যাখ্যার আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেছে।

প্রকৃতপক্ষে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ শব্দটাকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে বলে ইঞ্জিলের প্রকৃত অনুসারীরা সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন। তাই এখন শব্দটার রূপক ভাবার্থ উপলব্ধি করার জন্য আসুন আমরা আরো কতগুলো বিষয়ের দিকে নজর দেই।

ঈসা কালিমাতুল্লাহ্‌

কোরআন শরীফ ও ইঞ্জিল শরীফে ঈসা মসীহের আর একটি উপাধি ‘কালেমাতুল্লাহ্‌’ বা আল্লাহ্‌র বাণী লিপিবদ্ধ আছে। এ ক্ষেত্রেও উপাধিটাকে পরিষ্কারভাবে আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবে না। তিনি একটি আক্ষরিক কালাম, আওয়াজ, অক্ষর বা শব্দ নন। বরং এখানে ‘কালাম’ শব্দটাকে রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। রূপক অর্থে ‘কালাম’ হচ্ছে একটি মাধ্যম একজনের চিন্তা এবং ইচ্ছাকে অপরের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্র বা বাহক। ঠিক সেভাবে ঈসা মসীহ্‌ ছিলেন আল্লাহ্ এবং মানব জাতির সাথে আল্লাহ্‌তা’আলার যোগসূত্র। ঈসা মসীহের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর চিন্তাধারা এবং আকাঙ্খাকে মানুষের নিকট ব্যক্ত করতে পারতেন। এখন এটা সুস্পষ্ট যে, ‘খলিলুল্লাহ্‌’ উপাধিটার মতো ‘কালিমাতুল্লাহ্‌’ উপাধিটাকেও রূপক অর্থে বুঝতে ও গ্রহণ করতে হবে। তাই এটা আশ্চর্যজনক কিছু নয় যে, কিতাবের আর একটা উপাধি ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ রূপক অর্থে থাকবে।

এই ধরণের রূপক অর্থ শুধু ধর্মীয় বষয়ে নয়, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেমন এটা সহজভাবে প্রমাণ করা যায় যে, আমরা ঠিক যেভাবে ব্যাখ্যা দিতেছি ‘পুত্র’ ও ‘পিতা’ শব্দগুলো প্রায়ই সেইভাবে, রূপক অর্থে, ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পিতা শব্দের রূপক ব্যবহার

আসুন আমরা প্রথমে ‘পিতা’ এই শব্দটা পরীক্ষা করে দেখি এবং এর বিভিন্ন রূপক ব্যবহারের দিকে নজরদেই। এটা সাধারণভাবে বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি একটা জাতির পিতা। কিন্তু কেউই এতো বোকা নয় যে সে চিন্তা করবে যে ঐ নামীয় ব্যক্তিটি ঐ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্মদাতা পিতা। কিন্তু তা নয়, প্রকৃতপক্ষে এটা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু জাতীয় স্বাধীনতা এবং অগ্রগতিতে ওই ব্যক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাই তাঁকে সম্মান ও স্নেহসূচক ‘জাতির পিতা’ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়। এ শুধু একটি উপাধি। ঐ ব্যক্তি যে তার দেশের সাথে নিবিড় সম্পর্ক পোষণ করে, এই আখ্যার দ্বারা তাই প্রতিপন্ন হয়।

পিতার এই ধরনের রূপক ব্যবহার শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ্‌র প্রতি তা প্রয়োগ হতে দেখা যায়। আল্লাহ্‌ শেষ পর্যন্ত সব কিছুর স্রষ্টা, সরবরাহ্‌কারী ও পালনকারী। সূরা ফাতেহা “আলহামদুলিল্লাহ্‌ হি রাব্বুল আলামীন” বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে। এই সূরার উপর মন্তব্য করতে গিয় মোঃ আব্দুল হাকিম এবং মোঃ আলী হোসেন তাঁদের তফসিরে এই লিখেছেন ‘রব্ব’ শব্দ সম্বন্ধে:

কোন তাফসিরকার অনুমান করেন যে, আরবি ‘আব’ বা পিতৃ শব্দের মূল ধাতু হতেই ‘রব্ব’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সুতরাং পিতা বা প্রতিপালকই এর প্রকৃত মর্ম।”

আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে ব্যবহৃত ‘রব্ব’ শব্দকে আক্ষরিক অর্থ অনুযায়ী দৈহিক জন্মদাতা পিতা বলে ভুল বুঝে কেহই বোকামী করবেন না। যেহেতু এটা আল্লাহ্‌কে জড়িত করে, অবশ্যই এটা রূপক অর্থ ধারণ করে। আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টির দৈহিক পিতা নন। তবুও তার শক্তি এবং পরিচালনা ছাড়া কোন কিছুই সৃষ্টি হতে পারত না। তিনি সব কিছুর প্রকৃত সৃজনী শক্তি এবং ক্ষমতা, যা কিছু পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি দুনিয়ার রব্ব, রূপক এবং সৃজনী শক্তি।

বিষয়টিকে আরো অধিক ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধরলে, আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, পৃথিবীতে আগত প্রতিটি শিশুর জন্ম আল্লাহ্‌তা’আলার প্রত্যক্ষ সৃজনী শক্তির ফল। কত নিঃসন্তান দম্পতি আছে, যারা অত্যন্ত দুঃখের সাথে শাশ্বত সত্যকে উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ যতক্ষণ পর্যন্ত তার সৃজনী শক্তিকে কার্যকরী না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় গর্ভধারণ সম্ভব হবে না। আমরা গর্ব করতে পারি যে আমরা জন্মদাতা এবং একজন শিশুর পিতা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে স্বীকার করতে হয় যে, এরূপ পিতৃত্বের উপাধিটা প্রকৃতপক্ষে একমাত্র আল্লাহ্‌কেই দেয়া যেতে পারে। পুনরায়, আমরা আক্ষরিক এবং দৈহিক পিতৃত্বের কথা বলি না বরং সৃজনী শক্তি সক্ষম করণের কথা বলি। এরূপে উপরোক্ত কোরআনের তাফসীরকারীদের সাথে আমরা বলতে পারি যে, রূপকভাবে আল্লাহ্‌ মানুষসহ, সমস্ত সৃষ্টির পিতা।

পুত্রের রূপক ব্যবহার

আসুন আমরা এখন ‘পুত্র’ এই শব্দের রূপক ব্যবহারের দিকে নজর দেই। এমন একটি ব্যবহার কোরআনের সূরা বাকারা ২১৫ আয়াতে পাওয়া যায়। এই আয়াতে মুসাফির ও ভ্রমণকারীদেরকে ابْنِ السَّبِيلِ ইবনুস্‌সাবিলী বা ‘রাস্তার সন্তান’ বলা হয়ে থাকে। আবার আমরা দেখি যে, একটি আক্ষরিক ব্যাখ্যা কোন যুক্তি মানে না। কেবল মাত্র একজন বোকা লোক দৈহিক আত্মীয়তা মেনে নিতে বলবে। পরিষ্কার অর্থ অবশ্যই রূপক। পথের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে ব্যক্তিকে ‘রাস্তার পুত্র’ বলা হয়ে থাকে। অতঃপর আমরা দেখছি যে, রূপক ব্যবহারে ‘পুত্র’ বা ‘পিতা’ শব্দের মাধ্যমে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বুঝানো হয়। কিন্তু দৈহিক সম্পর্ক নয়।

অনুরূপ উপরোক্ত সিদ্ধান্ত ইঞ্জিল শরীফেও পাওয়া যায়। ইঞ্জিলের এরূপ একটি অংশ দেখা যায় যে, ঈসা মসীহ্‌ কয়েকজন ইহুদী আলেমের সাথে কথোপকথন করেছিলেন। তাদের অহমিকায় তারা ঈসা মসীহ্‌কে গর্বের সাথে বলল যে, তারা ইবরাহিম নবীর সন্তান। তখন ঈসা মসীহ্‌ বললেন আপনারা যদি ইবরাহিম নবীর সন্তান হতেন তাহলে ইবরাহিমের মতোই আল্লাহ্‌র ইচ্ছামাফিক চলতেন। তা না করে আপনারা পাপ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। সেইজন্য মসীহ্‌ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন—

“ইবলিসই আপনাদের পিতা আর আপনারা তারই সন্তান; সেইজন্য আপনারা তার ইচ্ছা পূর্ণ করতে চান।” (ইউহোন্না ৮:৪৪)

দৈহিক এবং আক্ষরিক জ্ঞানে ওই ইহুদীরা সত্যই নির্ভুল ছিল। তারা ছিল ইবরাহিম নবীর দৈহিক সন্তান ও উত্তরাধিকারী। কিন্তু ঈসা মসীহ্‌ আক্ষরিক অর্থের পশ্চাতে উক্ত শব্দের রূপকের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তাদের কার্যাবলী পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছিল যে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে তারা আল্লাহ্‌র বান্দা ইবরাহিম নবীর সাথে কোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখত না। রবং তাদের সম্পর্ক ছিল শয়তানের সাথে। এই কারণে, তাদেরকে শয়তানের সন্তান বলে সম্বোধন করা সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল।

আল্লাহ্‌র পুত্র শব্দের রূপক ও রূহানী অর্থ

সাধারণের কথাবার্তায় এবং আল্লাহ্‌র কালাএ ‘পিতা’ এবং ‘পুত্র’ শব্দগুলোর রূপক ব্যবহার পরীক্ষা করে, ইঞ্জিল শরীফে ব্যবহৃত ‘পুত্র’ শব্দটার রূপক অর্থ আমরা এখন বুঝতে সক্ষম হব। এটা লোকদেরকে আল্লাহ্‌র সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। শয়তান পরিচালিত ব্যক্তিকে যেমন ‘শয়তানের পুত্র’ বলা হয় তেমনিভাবে আল্লাহ্‌র সাথে যে ঘনিষ্ঠ রূহানী সম্পর্ক স্থাপন ও ভোগ করে, আল্লাহ্‌র দ্বারা যে পরিচালিত হয় তাকে ‘আল্লাহ্‌র সন্তান’ বা ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ইঞ্জিল শরীফে নিম্নলিখিত আয়াতে দেখতে পাই—

“যদি তোমরা গুনাহ্ স্বভাবের অধীনে চল তবে তোমরা চিরকালের জন্য মরবে। কিন্তু যদি পাক-রূহের দ্বারা শরীরের সব অন্যায় কাজ ধ্বংস করে ফেল তবে চিরকাল জীবিত থাকবে, কারণ যারা আল্লাহ্‌র রূহের পরিচালনায় চলে তারাই আল্লাহ্‌র সন্তান।” (রোমীয় ৮:১৩-১৪)

ইঞ্জিল শরীফের মধ্যে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ অতঃপর কোন দৈহিক সম্পর্কীয় ভাবার্থ বহন করে না। ইহুদী জাতি প্রথম দিকে যখন আল্লাহ্‌র আনুগত্য ও বিশ্বাসের মধ্যে ছিল, তখন তাদেরকে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলে সম্বোধন করা হতো। যে সমস্ত ইহুদী মতবিরোধের দিকে ঝঁুকে পড়েছিল, তাদেরকে শয়তানের সন্তান বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। ইহুদী বা অইহুদী, যে কেউ তার ভিতরের স্বার্থপর ও কামনা বাসনা কোরবানী করবে এবং আল্লাহ্‌র বিধানাদি অনুসরণ করবে, ইঞ্জিল শরীফে তাঁকেই ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়ে থাকে।

অতঃপর আমরা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারি কেন ঈসা মসীহ্‌কে ঐ উপাধি দেয়া হয়েছে। কেননা তিনি এমন একজন ব্যক্তি, আল্লাহ্‌র প্রতি যার আনুগত্য, নির্ভরতা এবং আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা; আমাদের দুর্বল, পাতলা অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের অনেক দূরে, অনেক উর্ধ্বে। এটা আরো পরিষ্কার যে, উপাধিটার বিরুদ্ধে প্রায় মাঝে মাঝে যা অভিযোগ করা হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে সব অভিযোগ থেকে মুক্ত। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার এবং নিশ্চিত যে, এটা আল্লাহ্‌র সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে না।

কোরআন শরীফ কি ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ কথাটি অস্বীকার করে?

এখন হয়ত কেউ বলবে যে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ কথাটার বিরুদ্ধে কোরআন শরীফের কথা ইঞ্জিল শরীফের সঙ্গে মিলানো যায় কিনা। আসুন আমরা কোরআন শরীফের এই আয়াতগুলো একটু দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু প্রথমে মনে রাখা দরকার যে আরবীতে ‘সন্তান’ এর জন্য দুটি আলাদা শব্দ আছে – ابْنِ ‘ইবন’ এবং وَلَدً ‘ওয়ালাদ’:

 

ইবন

(ابْنِ) শব্দ হল পুত্র সাধারণ শব্দ যেটা প্রায়ই অদৈহিক এবং রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়, যেমন ابْنِ السَّبِيلِ ইবনুস্‌সাবিলী (‘রাস্তার সন্তান’ অর্থাৎ মুসাফির)। কিতাবুল মোকাদ্দসে ব্যবহৃত ‘আল্লাহ্‌র সন্তান’ (হিব্রুতে ‘বিন’ (בּן) এবং গ্রীকে ‘হুইয়স’ (υἱός’) কথার জন্য এই হল সঠিক আরবী অনুবাদ।

‘ওয়ালাদ’ (وَلَدً) বোঝায় দৈহিক প্রক্রিয়ায় জন্মিত সন্তান, যেমন ‘শাবক’ বা ইংরেজি শব্দ offspring। আল্লাহ্‌র সঙ্গে হযরত ঈসা মসীহ্‌র পিতা-পুত্রের সম্পর্ক বোঝানোর জন্য এই শব্দ পুরোপুরি অনুপযুক্ত।

 

এখন এই বিষয় আমরা কোরআন শরীফের আয়াতগুলো দেখি:

“উহারা বলে, ‘দয়াময় আল্লাহ্‌ সন্তান (وَلَدً ওয়ালাদ ) গ্রহণ করিয়াছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! তাহারা তো তাঁহার সম্মানিত বান্দা।” (সূরা আম্বিয়া ২১:২৬)

“আল্লাহ্‌ সন্তান (وَلَدً ওয়ালাদ ) গ্রহণ করিতে চাহিলে তিনি তাঁহার সৃষ্টির মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা বছিয়া লইতেন। পবিত্র ও মহান তিনি। তিনি আল্লাহ্‌, এক, প্রবল পরাক্রমশালী।” (সূরা যুমার ৩৯:৪)

“তিনি গ্রহণ করেন নাই কোন পত্নী এবং না কোন সন্তান।” (সূরা জিন ৭২:৩)

“তিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তাঁহার সন্তান (وَلَدً ওয়ালাদ ) হইবে কিরূপে? তাঁহার তো কোন স্ত্রী নাই। তিনিই তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে তিনি সবিশেষ অবহিত।” (সূরা আন্‌’আম ৬:১০১, ২:১১৬, ১০:৬৮, ১৭:১১)

“‘হে মার্‌ইয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদিগকে বলিয়াছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহ্‌ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহ্‌রূপে গ্রহণ কর?’ সে বলিবে, ‘তুমিই মহিমান্বিত! যাহা বলার অধিকার আমার নাই তাহা বলা আমার পক্ষে শোভন নহে।” (সূরা মায়িদা ৫:১১৬)

উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে কোরআন ইঞ্জিলের শিক্ষা নিষেধ করছে না, বরং পুরোপুরি অন্য রকমের একটি জঘন্য ধারণা নিষেধ করছে। আমরা অনুমান করতে পারি যে তখনকার আরব দেশে একটি তথাকথিত ‘খ্রীষ্টান’ সম্প্রদায় ছিল যারা বিকৃত শিক্ষা দিত যে আল্লাহ্‌ হল প্রথম ইলাহ্‌, তার স্ত্রী মরিয়ম হল দ্বিতীয় ইলাহ্‌, এবং তাদের ‘ওয়ালাদ’ (সন্তান) ঈসা তৃতীয় ইলাহ্‌ (নাউজুবিল্লাহ!)। এই শিক্ষা অবশ্য ইঞ্জিল-বিরোধী এবং ভুল, এবং ঈসা মসীহ্‌র প্রতিটি প্রকৃত অনুসারী কোরআনের সঙ্গে একমত যে “তিনি কোন স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেননি”, এবং সেটা একটি জঘন্য ধারণা। যেহেতু কোরআন শরীফ বার বার ইঞ্জিলের সমর্থন করে এবং ইঞ্জিলে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ রূপকভাবে ব্যবহার করা হয়, সেহেতু এটা কোরআন শরীফের একমাত্র যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা।

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *