কেউ অপরের বোঝা বহন করিবে না
“ঈসা মসীহ্ আমাদের পাপ বহন করতে পারেন না, কারণ কোরআনে বলা হয়েছে “কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করিবে না” (সূরা ৫৩:৩৮)”
হযরত ঈসা মসীহ্ যে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করেছেন, তা আসলে কোরআন শরীফের এই আয়াতে অস্বীকার করা হচ্ছে না। আয়াতটি এরকম—
তাহাকে কি অবগত করা হয় নাই যাহা আছে মূসার কিতাবে, এবং ইব্রাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব? উহা এই যে, কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করিবে না” (সূরা নাজ্ম ৫৩:৩৬-৩৮)
কোরআনের এই আয়াত অনুযায়ী, এই শিক্ষা হযরত মূসা (আঃ) এর কিতাব থেকে এসেছে, যার মধ্যে এইভাবে বলা হয়েছে—
যে গুনাহ্ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। (ইহিষ্কেল ১৮:২০)
এখানে শেষ বিচারের শাস্তি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে না, বরং দুনিয়াবী শাস্তি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, কারণ তখনকার সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী, বাবার দোষের জন্য ছেলে শাস্তি পেত এবং ছেলের দোষের জন্য বাবা শাস্তি পেত। আবার এখানে জোর করে কারও ঘাড়ের উপর অন্যের শাস্তি ছাপিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, কিন্তু স্বেচ্ছাকৃতভাবে অন্যের শাস্তি বহন করা নিষিদ্ধ এখানে হয় নি।
আসলে, কোরআনের অন্যান্য আয়াতের দৃষ্টিতে, কোরআনের উপরোক্ত আয়াত কোন সর্বজনীন নিয়ম হিসাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না, কারণ—
১। কোরআন শরীফ নিজেই একটি সর্বজনীন নিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে। সরল মানুষ যারা বিপথে নিয়ে যায় এমন মন্দ লোকদের সম্বন্ধে সূরা নাহল ২৫ আয়াত বলে—
ফলে কিয়ামত দিবসে উহারা বহন করিবে উহাদের পাপভার পূর্ণ মাত্রায় এবং পাপভার তাহাদেরও যাহাদিগকে উহারা অজ্ঞতাহেতু বিভ্রান্ত করিয়াছে। দেখ, উহারা যাহা বহন করিবে তাহা কত নিকৃষ্ট! (সূরা নাহল ১৬:২৫)
আল কোরআন ইয়ুফাস্সিরু বা’’দুহু বা’দান (অর্থাৎ “কোরআনের বিভিন্ন অংশ পরপস্পরের ব্যাখ্যা দেয়”) নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের স্বীকার করতে হয় যে সূরা নাজ্ম ৩৮ আয়াতের নিয়মের প্রয়োগ সর্বজনীন নয় বরং সীমিত।
২। অনেক আগেই হযরত আদম (আঃ) এই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। কোরআন এবং তৌরাতের শিক্ষা অনুযায়ী, হযরত আদমের একটি পাপের ফলে সমস্ত মানব জাতি আর জান্নাতুল ফেরদৌসের বাগানে বাস করতে পারেনা বরং তাদেরকে দুঃখকষ্টের এই দুনিয়াতে বাস করতে হচ্ছে। অর্থাৎ, অন্য একজন ব্যক্তির পাপের শাস্তির ফল আমাদের বহন করতে হচ্ছে, অর্থাৎ ফেরদৌস থেকে বহিস্কার হয়ে আমাদের এই জগতে বাস করতে হচ্ছে।
আসলে, কিতাবুল মোকাদ্দস থেকে আমরা জানি কেন আদম আল্লাহ্র এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন। তা হল, মানব জাতির সঙ্গে সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে হযরত আদমের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। তেমনই আল্লাহ্র ইচ্ছায় মানব জাতির সঙ্গে একমাত্র নিষ্পাপ ব্যক্তি হযরত ঈসা মসীহ্র একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। এইজন্য ইঞ্জিল ঈসাকে বলেন “দ্বিতীয় আদম”, যেমন করে কোরআনও বলেছেন, “আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো” (সূরা আলে-‘ইমরান ৫৯ আয়াত)। ইঞ্জিলে এটার ব্যাখ্যা আছে—
আদমের সংগে যুক্ত আছে বলে যেমন সমস্ত মানুষই মারা যায়, তেমনি মসীহের সংগে যারা যুক্ত আছে তাদের সবাইকে জীবিত করা হবে” (১ করিন্থীয় ১৫:২২, এবং দেখুন ১৫:৪৫)
হযরত আদমের সঙ্গে আমাদের যেমন একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে, তেমনই হযরত ঈসার সঙ্গেও আমাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে।
এমন একটি সাধারণ নিয়ম কেন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভঙ্গ হয়, তা বোঝাবার জন্য আরেকটি নিয়মের সঙ্গে তা তুলনা করা যায়—“খুন করিয়ো না”। এই সাধারণ নিয়ম শুধুমাত্র ন্যায্যভাবে ভঙ্গ করা যায় যদি প্রধান বিচারপতি একজনকে মনোনীত করেন একটি বিশেষ ভূমিকার জন্য (ঘাতক বা জল্লাদ হিসেবে) মৃত্যুদণ্ড শাস্তি প্রদান করার জন্য। “অন্যের বোঝা বহন না করা”র নিয়মের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম থাকে যখন প্রধান বিচারপতি (আল্লাহ্) বিশেষ ভূমিকার জন্য একজনকে মনোনীত করেন (অর্থাৎ হযরত ঈসা মসীহ্কে)।
দ্বিতীয়তঃ হযরত ঈসা মসীহ্ এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার আরেকটি কারণ হল যে সমস্ত মানব জাতির মধ্যে কেবল তিনিই পুরোপুরি নিষ্পাপ। আল্লাহ্র ন্যায্যতা অনযায়ী, কোন পীর বা ফকির দ্বারা পাপ মোচন হয় না কারণ ধার্মিক মানুষ হয়েও এরা আমাদের মত পাপে কলঙ্কিত। যেহেতু একমাত্র হযরত ঈসা মসীহ্ নিষ্পাপ, অন্যের ভার স্বেচ্ছাকৃতভাবে বহন করার অধিকার কেবল তারই আছে।
তৃতীয়তঃ হযরত ঈসা মসীহ্ যে আল্লাহ্র ইচ্ছাতে মানব জাতির পাপের শাস্তি সলীবে বহন করেছেন তা ইঞ্জিল শরীফে অনস্বীকার্য। ইঞ্জিলে এমনকি তৌরাতেও তা বার বার বলা হয়েছে। একজন যে “অন্যের বোঝা বহন করতে পারে” আমরা তা অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু তাতে আমরা নিজেকে জাহান্নামের দিচ্ছি, কারণ আমরা পাপের নিশ্চিত শাস্তির একমাত্র রেহাইকে অস্বীকার করছি এবং আল্লাহ্র রহমত এবং ক্ষমার ব্যবস্থা তুচ্ছ করছি। তার থেকে আল্লাহ্র আশ্চর্য দান নম্রভাবে গ্রহন করা অনেক ভাল।
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:
Leave a Reply